আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর পরিচয় ও বিশ্বাস

‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ’ কথাটির অর্থ:

‘আহাল’ আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছেঃ পরিবার-পরিজন, দল, গোষ্ঠী বা জনসমষ্টি।

‘সুন্নাহ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছেঃ তরীকা বা রীতি, পথ, পদ্ধতি, নিয়ম স্বভাব, সেটা ভালো হতে পারে বা খারাপও হতে পারে।

মুহাদ্দিসিন একরাম বা হাদীস শাস্ত্রবিদদের নিকট ‘হাদীস’ শব্দের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘সুন্নাহ’ বা ‘আসার’।

‘জামায়াহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ সুসংগঠিত দল, তার মাঝে লোকের সংখ্যা কম হোক বা বেশি হোক।

ইসলামী পরিভাষায় ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ’ হচ্ছে সেই দল বা জনসমষ্টি, যারা ক্বুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবাদের আদর্শের অনুসরণ করে।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ হচ্ছে যারা ক্বুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত বিষয়ের উপরে এবং এই উম্মতের সালাফগণ (পূর্ববর্তী অর্থাৎ সাহাবারা) যার উপর একমত বা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।”

(মিনহাজু আহলিস সুন্নাহঃ খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৮৩)


ইসলামী জ্ঞান অন্বেষণের মূল উৎস এবং উহার প্রমাণপঞ্জি উপস্থাপনের পদ্ধতি


১. ইসলামী আকীদা গ্রহণের মূল উৎস কুরআনে করীম, সহীহ হাদীস ও সালফে-সালেহীনের ইজমা।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত সহীহ হাদীস গ্রহণ করা ওয়াজিব, এমনকি তা যদি খবরে আহাদও হয়।
৩. কুরআন-সুন্নাহ বুঝার প্রধান উপাদান, কুরআন সুন্নারই অন্যান্য পাঠ, যার মধ্যে রয়েছে অপর আয়াত বা হাদীসের স্পষ্ট ব্যাখ্যা, এছাড়া আমাদের পূর্বসূরী সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং আমাদের সম্মানিত ইমামগণ প্রদত্ত ব্যাখ্যা। আর আরবদের ভাষায় যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। তবে ভাষাগত দিক থেকে অন্য কোন অর্থের বম্ভাবনা থাকলেও সাহাবা, তাবেয়ীনদের ব্যাখ্যার বিপরীত কোন ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যাবে না। সম্ভাব্য কোন অর্থ এর বিপরীত কোন অর্থ বহন করলেও তাঁদের ব্যাখ্যার উপরেই অটল থাকতে হবে।
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের মূল বিষয়বস্তুসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছেন। এজন্য দ্বীনের মধ্যে নতুন করে কোন কিছু সংযোজন করার কারও অধিকার নেই।
৫. প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সর্ব বিষয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সামনে আত্মসমর্পন করা। সুতরাং নিজের মানসিক ঝোঁক বা ধারণার বশঃবর্তী হয়ে, আবেগপ্রবণ হয়ে অথবা বুদ্ধির জোরে বা যুক্তি দিয়ে কিংবা কাশফ অথবা কোন পীর-উস্তাদের কথা, কোন ইমামের উক্তির অজুহাত দিয়ে কুরআন সুন্নাহর কোন কিছুর বিরোধিতা করা যাবে না।
৬. কুরআন, সুন্নার সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের কোন সংঘাত বা বিরোধ নেই। কিন্তু কোন সময় যদি উভয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয় এমতাবস্থায় কুরআন সুন্নাহর অর্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৭. আকীদা সংক্রান্ত বিষয়ে শরী‘আতসম্মত ভাষাও শব্দ প্রয়োগ করা এবং বিদ‘আতী পরিভাষাসমূহ বর্জন করা আর সংক্ষেপে বর্ণিত শব্দ, বাক্য বা বিষয়সমূহ যা বুঝতে ভুল-শুদ্ধ উভয়েরই সম্ভাবনা থাকে, এমতাবস্থায় বক্তা থেকে ঐ সমস্ত বাক্য বা শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া, তারপর তন্মধ্য থেকে যা হক বা সঠিক বলে প্রমাণিত হবে তা শরী‘আত সমর্থিত শব্দের মাধ্যমে সাব্যস্ত করতে হবে, আর যা বাতিল তা বর্জন করতে হবে।
৮. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন নিষ্পাপ, ভ্রুল-ত্রুটির উর্ধ্বে। আর সামষ্টিকভাবে মুসলিম উম্মাহও ভ্রান্তির উপরে একত্রিত হওয়া থেকে মুক্ত। কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত) এ উম্মতের কেউই নিষ্পাপ নন। আমাদের সম্মানিত ইমামগণ এবং অন্যান্যরা যে সব বিষয়ে মত পার্থক্য করেছেন, সে সমস্ত বিষয়ের সূরাহার জন্য কুরআন ও সুন্নার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তবে উম্মতের মুজতাহিগণের যে সমস্ত ভুল-ত্রুটি হবে সেগুলোর জন্য সঙ্গত ওজর ছিল বলে ধরে নিতে হবে। [অর্থাৎ ইজতিহাদী ভুলের কারণে তাঁদের মর্যাদা সমুন্নতই থাকবে এবং তাঁদের প্রতি সুন্দর ধারণা পোষণ করতে হবে।]
৯. এ উম্মতের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান সমৃদ্ধ ও ইলহামপ্রাপ্ত অনেক মনীষী রয়েছেন। সুস্বপ্ন সত্য এবং তা নবুওয়াতের একাংশ। সত্য-সঠিক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের বাণী সত্য এবং তা শরী‘আত সম্মতভাবে কারামত বা সুসংবাদের অন্তর্ভুক্ত। তবে এটি ইসলামী আকীদা বা শরী‘আত প্রবর্তনের কোন উৎস নয়।
১০. দ্বীনের কোন বিষয়ে অযথা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া অত্যন্ত জঘন্য ও নিন্দনীয়। তবে উত্তম পন্থায় বিতর্ক বৈধ। আর যে সমস্ত বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া থেকে শরী‘আত নিষেধ করেছে, তা থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য। এমনিভাবে অজানা বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হওয়াও মুসলিমদের জন্য অনুচিৎ, বরং ঐ অজানা বিষয় সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী আল্লাহর উপর সোপর্দ করা উচিৎ।
১১. কোন বিষয়ে বর্জন গ্রহণের জন্য ওহির পথ অবলম্বন করতে হবে। অনুরূপভাবে কোন বিষয় বিশ্বাস বা সাব্যস্ত করার জন্যও ওহীর পদ্ধতির অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং বিদ‘আতকে প্রতিহত করার জন্য বিদআতের আশ্রয় নেয়া যাবে না। আর কোন বিষয়ের অবজ্ঞা ঠেকাতে অতিরঞ্জন করার মাধ্যমে মোকাবেলা করা যাবে না। অনুরূপ কোন বিষয়ের অতিরঞ্জন ঠেকাতে অবজ্ঞাও করা যাবে না। [অর্থাৎ যতটুকু শরী‘আত সমর্থন করে ততটুকুই করা যাবে]
১২. দ্বীনের মধ্যে নব সৃষ্ট সব কিছুই বিদ‘আত এবং প্রতিটি বিদ‘আতই হলো পথভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক পথভ্রষ্টতার পরিণতিই জাহান্নাম।

পাদটিকা
[১] তন্মধ্যে তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত ও তাওহীদুর উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতের ক্ষেত্রে তাওহীদ অন্যতম।
[২] খবরে আহাদ ঐ হাদীসকে বলে, যে হাদীস পরস্পরায় অসংখ্য সাহাবী হতে বর্ণিত হয় নি।

Post a Comment

Previous Post Next Post