তাকওয়া কি এবং কিভাবে ?

‘মুত্তাকী’ ও ‘পরহেযগা’র শব্দ দুটি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। কিন্তু কাকে বলে মুত্তাকী? কী কী বৈশিষ্ট্যের দ্বারা মানুষ আল্লাহর কাছে মুত্তাকী বলে গণ্য হয়? মুত্তাকী মানে কি মাসুম ও নিষ্পাপ হওয়া? ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে হওয়া? কখনো কোনো গোনাহ হয়ে গেলে কি মানুষের নাম মুত্তাকীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়? কিংবা পাপী ও গুনাহগারদের জন্যে কি খোলা নেই মুত্তাকী হওয়ার দরজা?

অন্যদিকে শুধু ঈমান আনার দ্বারাই কি পাপাচারের কুফল থেকে মুক্ত থাকা যায়? পাপাচার কি মানুষের জন্যে কোনো আশঙ্কাই তৈরি করে না? পাপের কোনো পর্যায়ই কি এমন নেই, যা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে? আজকের দরসে আমরা এসকল প্রশ্নের জবাব পাবার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

সূরা আ‘রাফের (৭ : ২০১-২০২) প্রথম দুই আয়াতে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য ও ইখওয়ানুশ শায়াতীন-এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। অন্য ভাষায় বলা যায়, ‘ইবাদুর রাহমান’ ও ‘ইবাদুশ শাইতান’ তথা আল্লাহর বান্দা ও শয়তানের বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এ দুই আয়াত আমাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মতো গোনাহগার, যারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যাই, গোনাহে লিপ্ত হয়ে যাই- এই সকল মানুষের জন্য এ দুই আয়াতে যেমন আছে গভীর সান্ত্বনা, তেমনি আছে অতি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ।

আল্লাহ পাক হলেন রাহমানুর রাহীম। অতি দয়ালু, পরম করুণাময়। দয়া ও করুণার কারণে তিনি কুরআন মাজীদে এমন সব বিবরণ, এমন সব নির্দেশনা ও উপস্থাপনা রেখেছেন যার উপলব্ধি অর্জিত হলে কোনো কিছুই বান্দাকে আল্লাহ পাকের সামনে সমর্পিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে না।

এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে যখন তাদেরকে স্পর্শ করে শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কিছু; কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা, তখন তারা স্মরণ করে; আল্লাহকে স্মরণ করে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ স্মরণ করে। ফলে তাদের চোখ খুলে যায়, করণীয় স্পষ্ট হয়ে যায়। এ হচ্ছে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য।

মুত্তাকী মানে কী? মুত্তাকী মানে কি মাসুম বা নিস্পাপ? না। মাসুম বা নিস্পাপ তো ছিলেন নবী রাসূলগণ। আল্লাহ যাদের তৈরিই করেছেন এমনভাবে যেন তাঁরা গোটা মানবজাতির জন্যে আদর্শ হতে পারেন। তাঁরাই যদি গোনাহে লিপ্ত হতেন (নাউযুবিল্লাহ) তাহলে তো মানুষ আরো বেশি গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়বে। তো মাসুম হওয়া নবী-রাসূলের বৈশিষ্ট্য। তেমনি তা ফিরিশতাদের বৈশিষ্ট্য। ফিরিশতাদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে বলেছেন-

অর্থাৎ তারা আল্লাহ পাকের কোনো আদেশ অমান্য করেন না। আর আল্লাহ পাক তাদের যে আদেশ করেন তা পালন করেন । -সূরা তাহরীম ৬৬ : ৬

মুত্তাকী হলেন আল্লাহ পাকের ঐসকল বান্দা, যাদের অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয় আছে এবং যারা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকেন। আল্লাহকে স্মরণ করার এক পর্যায় হল, গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ বলেন-

‘পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’-সূরা নাযিআত ৭৯ : ৪০-৪১

গুনাহের পরিস্থিতি অনেক রকম হতে পারে। যেমন ক্রোধের পরিস্থিতি। কারো প্রতি ক্রোধ জাগ্রত হয়েছে, এ অবস্থায় আল্লাহর ভয়ে সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে মুত্তাকী হিসাবে গণ্য হয়। বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মুজাহিদ রাহ. আলোচিত আয়াতের ‘শয়তানের পক্ষ হতে কুমন্ত্রণাকে’ ‘ক্রোধ’ শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। এটি একটি ক্ষেত্র। এ রকম আরো অনেক ক্ষেত্র হতে পারে। অন্যান্য গুনাহের পরিস্থিতিতেও আল্লাহর ভয়ে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করার দ্বারা ‘তাকওয়ার’ পরিচয় পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর শব্দটি ব্যাপক। তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন অর্থাৎ ‘শয়তানের প্ররোচনা’।

মোটকথা গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং গুনাহ ত্যাগ করা তাকওয়ার একটি প্রকার। এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কাছে মুত্তাকী হিসাবে গণ্য।
আল্লাহকে স্মরণ করার দ্বিতীয় পর্যায় হল গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর স্মরণ করা। মুত্তাকী বান্দার কখনো কোনো গোনাহ হয় না, তা নয়। স্খলন হতে পারে, ভুল হতে পারে, কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য হল, গুনাহ হয়ে গেলে মনে অনুতাপ জাগে, আল্লাহর ভয় জাগে এবং এই উপলব্ধি জাগে যে, আমি আমার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। আর তখন সে তার করণীয় স্পষ্ট দেখতে পায় যে, আমাকে এই অবস্থা থেকে ফিরতে হবেই। সে ব্যাকুল হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। এটিও তাকওয়ার একটি সত্মর এবং মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদের সম্পর্কেও আছে জান্নাতের সুসংবাদ। সূরা আলে ইমরানে, যেখানে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, সেখানে আছে-

‘এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করে ফেলে জেনে বুঝে তাতে অটল থাকে না।’ -সূরা আলে ইমরান : ৩ : ১৩৫

তো এ আয়াতে তাকওয়ার এ পর্যায়টির কথা পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য আয়াত এ পর্যায়কেও শামিল করে। ইমাম সুদ্দী রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ঐ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, অর্থাৎ যখন তাদের পদস্খলন ঘটে তখন তওবা করে।

জামে তিরমিযীতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.থেকে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেন,
আমি আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কেউ যখন কোনো গুনাহ করে ফেলে এরপর (তার বোধোদয় হয় এবং সে ) উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, এরপর নামায পড়ে, এরপর আল্লাহর কাছে মাফ চায়, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪০৬

যখন কোনো বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরতে শুরু করে তখন আল্লাহ কত খুশি হন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি কোনো মরুভূমিতে সফর করছে। যে উটে সফর করছে তাতেই তার পাথেয় ও সামানা। কোথাও হয়ত যাত্রা বিরতির জন্য একটু নেমেছে। এদিকে সুযোগ পেয়ে উটটি পালিয়ে গেল। এখন এই ধূ ধূ মরুভূমিতে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই প্রান্তর পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়, আর পানি ও পাথেয় ছাড়া বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। অতএব মৃত্যুর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে এক গাছের নিচে এসে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখে, তার সেই উট সব পাথেয়সহ তার সামনে উপস্থিত। আনন্দের আতিশয্যে ভুলে বলে ফেলেছে (হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব!) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ বান্দা ঐ মুহূর্তে তার উট ফিরে পেয়ে যে পরিমাণ আনন্দিত হয়, আল্লাহ পাক তার ফিরে আসা বান্দার প্রতি তারচেয়েও বেশি খুশি হন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৬


আল্লাহ পাকের কি আনন্দিত হওয়ার কোনো দরকার আছে? এই বান্দা যদি তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে তাতে কি আল্লাহ পাকের কোনো লাভ আছে? তাতে কি আল্লাহ পাকের বড়ত্ব ও মহত্ত্ব বেড়ে যাবে? আল্লাহ পাকের রাজত্ব বেড়ে যাবে? কিছুই হবে না। এটা হল আল্লাহ পাকের রহম ও করমের প্রকাশ, তাঁর দয়া ও করুণার প্রকাশ যে, তাঁর কোনো বান্দা তওবা করে ফিরে এলে তিনি খুশি হন। সহীহ মুসলিমের আরেক হাদীসে আছে –

আল্লাহ পাক রাতের বেলা তাঁর হাত প্রসারিত করেন যেন দিনের অপরাধী তাঁর দিকে ফিরে আসে। আবার দিনের বেলা তাঁর হাত প্রসারিত করেন যেন রাতের অপরাধী তাঁর দিকে ফিরে আসে। এবং এভাবে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া- অর্থাৎ কিয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাঁর গোনাহগার বান্দাদের জন্য তাঁর দয়া ও করুণা প্রসারিত রাখেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস

তো মুত্তাকী ও পরহেযগার বান্দা তারাই যাদের অন্তরে শয়তান যখন কোনো কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং গোনাহ থেকে বিরত থাকে। কিংবা কখনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে।

পক্ষান্তরে যারা শয়তানের ভাই-বেরাদার তাদের অবস্থা কী? তাদের অবস্থা হল-
শয়তান তাদেরকে গোমরাহীর পথে মদদ দিতে থাকে এবং এগিয়ে নিতে থাকে। আর এবিষয়ে কোন ত্রুটি করে না। ফলে ওরা চূড়ান্ত গোমরাহীতে গিয়ে নিপতিত হয়। এরপর সে অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হয়। আর আল্লাহ তাআলার সামনে তারা শয়তানের ভাই হিসাবেই উপস্থিত হয়। তো আল্লাহ পাকের কোনো বান্দা যদি তাঁর সামনে তাঁর সবচে’ বড় অবাধ্য-শয়তানের দোসর হিসাবে উপস্থিত হয় তার পরিণাম কী হবে?! তার পরিণাম তো অত্যন্ত ভয়াবহ। এজন্য গোনাহর চিন্তা মনে এলেই আল্লাহর আশ্রয় নেয়া উচিত। আর কখনো গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে ভাবা উচিত যে, আমি ভুল পথে আছি। এই পথ আমাকে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত করবে। এই পথ আমাকে আখেরাতে ধ্বংস করবে। এই পথ আমার সুনাম-সুখ্যাতি মান-মর্যাদা সব ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। এইভাবে চিন্তা করা উচিত। যখন মানুষ এইভাবে চিন্তা করে তখন তার ফিরে আসা সহজ হয়ে যায়।

তওবা কাকে বলে? আলিমগণ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তওবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে যে, কারো যখন গোনাহ হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে সেই গোনাহ পরিত্যাগ করবে। সেই গোনাহর জন্যে অনুতপ্ত হবে এবং ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করবে। আর সেই গোনাহর ক্ষতিপূরণের কোনো বিধান যদি শরীয়তে থাকে তাহলে তা পালন করবে। যেমন কারো নামায কাযা হয়ে গেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকদিন নামায পরিত্যাগ করেছে। তাহলে তাকে সেই নামাযগুলোও কাযা করতে হবে। এমনিভাবে কেউ যদি কারো কাছ থেকে অন্যায়ভাবে সম্পদ নিয়ে থাকে। ছিনতাই বা আত্মসাৎ করে থাকে, তাহলে তার তওবা শুধু এটুকুই নয় যে, সে অনুতপ্ত হবে এবং ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করবে; বরং তাকে সেই লুণ্ঠিত বা আত্মসাৎকৃত সম্পদও ফিরিয়ে দিতে হবে। সুতরাং তওবা পূর্ণ হয় তিন কাজের দ্বারা : এক. অনুতপ্ত হওয়া। দুই. গোনাহ ছেড়ে দেওয়া ও ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা। তিন. ক্ষতিপূরণের যে বিধান ইসলামী শরীয়তে আছে তা পালন করা। এই তিন কাজ যখন হয় তখন তওবা পূর্ণ হয়। তখন আল্লাহ পাক ঐ বান্দাকে কবুল করেন।

কুরআন মাজীদের ফরমান, আল্লাহ পাক বান্দার তওবা খুব কবুল করেন। বারবার কবুল করেন। আল্লাহ পাকের এক পবিত্র নাম ‘আততাওয়াব’। অর্থাৎ আল্লাহ পাক বান্দার দিকে বারবার রহমতের দৃষ্টি দেন। বারবার তওবা কবুল করেন। কুরআন মাজীদে এসেছে ‘আততাওয়াব’ নামের সাথে আনা হয়েছে ‘আর রাহীম’ নাম। অর্থাৎ আল্লাহ পাক তাঁর দয়া ও করুণার কারণে বান্দার তওবা বারবার কবুল করেন।

তো এই আয়াতে আল্লাহ পাক আমাদের জন্যে, আমাদের বাস্তব জীবনের জন্যে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি দান করেছেন। গোনাহকে সামান্য মনে না করা। অন্তরে গোনাহর ভাব সৃষ্টি হওয়ামাত্র সাবধান হওয়া। আর কখনো গোনাহ হয়ে গেলে হতাশ না হওয়া। আল্লাহ পাকের রহমত থেকে তো ঐ ব্যক্তি হতাশ হয়, যে আল্লাহ পাকের রহমতকে ছোট মনে করে। আল্লাহ পাক এক হাদীসে কুদসীতে তার মাগফিরাতের প্রশস্ততা বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন,আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে,আল্লাহ বলেন-
হে আদমসন্তান! তোমার পক্ষ হতে যা-ই প্রকাশ পাক, যে পর্যন্ত তুমি আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে আশা করতে থাকবে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে থাকব এবং আমি কোনো পরোয়া করব না। তোমার গোনাহ যদি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, (পৃথিবীর সকল শূন্যতা ভরাট করে) আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এরপর তুমি ইসতিগফার কর। তো আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব এবং কোনো পরোয়াই করব না। হে আদমসন্তান! তুমি যদি আমার কাছে আস পৃথিবী-ভরা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আর আস কোনো কিছুকে আমার সাথে শরীক না করে তাহলে আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব পৃথিবী-ভরা মাগফিরাত নিয়ে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪০


আল্লাহ পাক এত বেনিয়ায, এত অমুখাপেক্ষী যে, বান্দাকে ক্ষমা করার জন্যে কোনো কিছুর পরোয়া করার দরকার পড়ে না। ‘এত বড় গোনাহগার এত বড় পাপী! কীভাবে আপনি তাকে ক্ষমা করলেন’- এমন প্রশ্ন করার কেউ নেই। সেজন্যে আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তোমাকে মাফ করে দেব এবং কোনো পরোয়াই করব না।

তো যে মালিক এভাবে বান্দাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত সেই মালিকের কাছ থেকে কেন আমি ক্ষমা নেব না? কেন তাঁর কাছে ছুটে যাব না?

আগের যুগের একজন মানুষের ঘটনা আছে যে নিরানববইজন মানুষকে খুন করেছিল। এরপর একসময় তার মধ্যে অনুতাপ এল যে, আমি এত মানুষ হত্যা করে ফেললাম! আমি এত খারাপ! এত পাপী!? তখন সে এক দরবেশের কাছে গিয়ে বলল, আমি তো একে একে নিরানববইজন মানুষকে হত্যা করেছি, আমার কি মুক্তির কোনো পথ আছে? দরবেশ আলেম ছিলেন না। তিনি হয়তো চিন্তা করলেন, যেখানে একজন মানুষকে হত্যা করলেই জাহান্নাম অবধারিত সেখানে নিরানববই হত্যা! বললেন, ‘না তোমার মুক্তির কোন উপায় নেই।’ সেই লোক উত্তেজিত হয়ে দরবেশকেও হত্যা করল এবং তার মাধ্যমে একশ পূর্ণ করল। এরপরও তার মনে যন্ত্রণা, আসলেই কি আমার মুক্তির কোনো উপায় নেই?! আবার গেল একজনের কাছে। তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন আলেম। তাকে গিয়ে বলল,‘আমার কি মুক্তির কোনো পথ আছে?’ তিনি বললেন, ‘কেন থাকবে না? অবশ্যই আছে। তোমার জন্যে তওবার সুযোগ আছে। তুমি গোনাহ করেছ। অনেক বড় অপরাধ করেছ। তাই বলে নিরাশ হবে কেন? আল্লাহ পাকের ক্ষমা, আল্লাহ পাকের দয়া তো তোমার গোনাহর চেয়েও বড়। সুতরাং তুমি নিরাশ হয়ো না। এক কাজ কর, যে এলাকায় তুমি আছ সেটা ভালো না। ওখানের পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে তুমি গোনায় জড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি অমুক এলাকায় চলে যাও। ওখানে কিছু ভালো মানুষ আছে। তাদের সাথে মিশে ওখানেই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে থাক। হতে পারে আল্লাহ পাক তোমার ইবাদত বন্দেগীর ওসীলায় তোমাকে মাফ করবেন, তোমার তওবা কবুল করবেন।’ এ কথা শোনার পর যেন তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। সে তখন মুক্তির আশায় ঐ এলাকার দিকে রওয়ানা হল। কিন্তু আল্লাহর হুকুম- ঐ এলাকায় পৌঁছার আগেই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত উপস্থিত। তার মৃত্যু হয়ে গেল। এখন দুই দল ফিরিশতা এসে গেল তার রূহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। জান্নাতের ফিরিশতা এবং জাহান্নামের ফিরিশতা। জাহান্নামের ফিরিশতারা বলছে, এই লোক অনেক বড় পাপী। একশ মানুষের খুনি। আমরা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাব। আর জান্নাতের ফিরিশতারা বলছে, সে তো তওবা করেছে। সুতরাং আমরা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাব। এভাবে যখন ফিরিশতারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না তখন তারা আল্লাহ তাআলার কাছে গেল। আল্লাহ তায়ালা তো সব জানেন। তিনি বললেন, তোমরা তার মৃত্যুর জায়গা ও দুই এলাকার দূরত্ব মেপে দেখ। যে এলাকার দিকে সে যাচ্ছিল যদি সেটা নিকটে হয় তাহলে তাকে জান্নাতে নিয়ে যাও। কারণ সে ভালোর দিকে বেশি অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। আর যদি যে এলাকা থেকে এসেছে সেটা নিকটে হয় তাহলে ধরে নাও সে ভালোর দিকে বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। ফিরিশতারা উভয় দিকের জায়গা মেপে দেখল। এক রেওয়ায়েতে আছে, সে ভাল মানুষদের এলাকার কাছাকাছি যেতে পারেনি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঐ যমীনকে বললেন- তুমি নিকটে আস। আর পেছনের পথকে বলেছেন- তুমি দীর্ঘ হয়ে যাও। ফলে সে ঐ ভালো অঞ্চলের নিকটবর্তী প্রমাণিত হল এবং জান্নাতের ফিরিশতারা তাকে জান্নাতে নিয়ে গেল।

এই হল আল্লাহ পাকের রহম ও করমের অবস্থা। আল্লাহ পাকের দয়া ও করুণার দৃষ্টান্ত। সুতরাং যিনি এত রহমান, এত রাহীম, যিনি তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার জন্যে এত আগ্রহী তার আশ্রয় কেন আমরা গ্রহণ করব না? তাঁর অবাধ্যতা কেন বর্জন করব না? কেন আমরা পবিত্র জীবন গ্রহণ করব না? তো কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় বান্দাকে তওবার দিকে ডেকেছেন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেজন্যে আমাদের কর্তব্য, গোনাহ হয়ে গেলেই তওবা করা। সেই রহমান ও রাহীম আল্লাহর কাছে ফিরে আসা এবং তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করা।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। সবাইকে কবুল করুন। সবাইকে তাঁর নৈকট্যশীল ও প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।

Post a Comment

Previous Post Next Post