তাকওয়ার পরিচয়

তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে খোদাভীতি তথা গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা। হজরত ওমর (রা.) একবার হজরত কাব আল আহবারকে তাকওয়ার সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনও কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেছেন, হজরত ওমর (রা.) বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তখন আপনি কি রূপ সতর্কতা অবলম্বন করেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, আমি পরিধেয় বস্ত্র সংযত করে চলি। হজরত কাব (রা.) বলেন, এটাই হচ্ছে তাকওয়া। এ কথা থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীতে পাপ-পঙ্কিলতার কাঁটা ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। তা হতে সতর্কভাবে আত্মরক্ষা করে চলার নাম হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া অবলম্বনকারীকে মুত্তাকি বলা হয়। আল্লাহপাক মুত্তাকির পরিচয় দিয়ে বলেন, 'পবিত্র কোরআন হচ্ছে মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশক, যারা অদৃশ্যে ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, আল্লাহর দেয়া জীবিকা থেকে ব্যয় করে এবং যারা আপনার প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে এবং আপনার আগে যা নাজিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনে এবং আখেরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।' (সূরা বাকারা : ৩-৪)।


পবিত্র কোরআনে তাকওয়া শব্দটি এসেছে ১৫ বার। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা 'ইত্তাকু' শব্দটি কোরআনে বহুবার উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ 'তোমরা ভয় করো' যেমন আল্লাহপাক এরশাদ করেন, 'হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না।' (সূরা আলে ইমরান : ১৩)। আরও উল্লেখ আছে, 'তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি বেশি মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি।' (সূরা হুজরাত : ১৩)।


তাকওয়া একটি উন্নতর মানবীয় গুণ। তাকওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে ইহজগতে সৎ ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করে পরজগতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব নয়। কারণ সব সময় মানুষ অসৎ ও অনিষ্টকর কাজ করার জন্য এবং খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত হয়। তাই তাকওয়া বা খোদাভীতি ছাড়া এসব থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'হে মোমিনরা, যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়।' (সূরা আনফাল : ২৯)। আল্লাহ পাক আরও বলেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য একটা পথ করে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে দান করেন যা সে কল্পনাও করে না।' (সূরা তালাফ : ২-৩) । 'যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজকে সহজ করে দেন।' (সূরা তালাক : ৪)।


তাকওয়া হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের অন্যতম সেতুবন্ধ, একজন মুসলমান তার আরেক মুসলমান ভাইকে ভালোবাসবে, সাহায্য-সহযোগিতা করবে শুধু আল্লাহর ভয়ে। যদি প্রতিদান পাওয়ার আশায় কোনো মুসলমানকে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয় তাহলে তার আমলগুলোর কোনো সওয়াব পাওয়া যাবে না। নিঃস্বার্থভাবে অপরকে ভালোবাসতে হবে।


হাদিস শরিফে রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসল তারই জন্য কাউকে ঘৃণা করল, তারই জন্য কাউকে দান করল এবং তারই জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকল সে অবশ্যই ঈমানকে পূর্ণতা দান করল। (আবু দাউদ শরিফ)।


হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই যে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে অপমানিত করে না তাকে অসহায় বন্ধুহীন করে না। তাকওয়া এখানে এই বলে তিনি নিজ বক্ষের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করেন। (মুসলিম শরিফ)।


বর্তমান সমাজে আমরা যে নৈতিক অবক্ষয় পরিলক্ষণ করি যেমন মেয়েদের উত্যক্তকরণ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমাদের মধ্যে তাকওয়া তথা খোদাভীতির অভাব।


বিশিষ্ট দার্শনিক ইমাম জাকালি (রা.) বলেন, তাকওয়ার স্তর হচ্ছে চারটি_



* শরিয়ত যেসব বস্তু হারাম করেছে, সেসব বস্তু থেকে বিরত থাকা। যেমন মদ-সুদ, জুয়া, জেনা ব্যভিচার ইত্যাদি। এটা সাধারণ মোমিনের তাকওয়া এ শ্রেণীর মুত্তাকিকে বলা হয় মোমিন।


* হারাম বস্তু থেকে বিরত থাকার পর সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তুগুলো থেকে দূরে থাকা। এ শ্রেণীর মুত্তাকিকে বলা কথা হয় সালেহ।


* যাবতীয় হারাম বস্তু ও সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তুগুলো থেকে দূরে থাকার পর আল্লাহ তায়ালার ভয়ে অনেক সন্দেহবিহীন হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করে_ এ শ্রেণীর লোককে বলা যায় মুত্তাকি।


* উপরোলি্লখিত তিন শ্রেণীর তাকওয়া আয়ত্ত করার পর এমনসব হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা, যা ইবাদতে কোনোরূপ সহায়তা করে না। এ শ্রেণীর মুত্তাকিকে বলা হয় সিদ্দিক।




লেখক : পরিচালক, গবেষণা বিভাগ

ইসলামিক ফাউন্ডেশন

Post a Comment

Previous Post Next Post