বিয়ের মোহর - স্পষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরী

মোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরয, কিন্তু এ বিষয়ে সমাজে চরম অজ্ঞতা ও উদাসীনতা বিরাজমান। দ্বীন-ধর্মকে ভালবাসেন এবং নামায-রোযা করেন এমন অনেক মানুষও মোহরের বিষয়ে সচেতন নন। এ বিষয়ে উদাসীনতা এত প্রকট যে, অনেকে নফল নামায পড়াকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, মোহর আদায়কে তার সিকি ভাগও মনে করেন না। অথচ তা একটি ফরয বিধান ও বান্দার হক, যা আদায় করা ছাড়া মানুষ প্রকৃত দ্বীনদার হতে পারে না। এজন্য প্রথমেই দরকার মোহরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। এরপর তা আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। ঈমানদার ভাইদের মাঝে যেন এই অবহেলিত ফরয বিধানটি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়-এই শুভ কামনা থেকেই বর্তমান সংখ্যার এই সামান্য আয়োজন। এখানে মোহর বিষয়ে চারটি লেখা পত্রস্থ হল। লেখাগুলি পাঠ করে কারো মনে যদি আমলের প্রেরণা জাগে তাহলেই আমাদের শ্রম সার্থক হবে।
আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকল আমলকে কবুল করুন। আমীন।-সম্পাদক

মোহর ও সামাজিক প্রচলন
মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী
কিছুদিন আগে একটি নিকাহনামা দেখেছিলাম, যাতে মোহরের ঘরে লেখা ছিল ‘নগদ বত্রিশ টাকা শরয়ী মোহর’। এর আগেও লোকদের সাথে কথাবার্তার মধ্যে মনে হয়েছে, তারা বত্রিশ টাকাকে শরীয়তের নির্ধারিত মোহর মনে করে। আর এই ধারণা তো অনেকেরই আছে যে, মোহরের পরিমাণ যত কম হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে ততই উত্তম ও প্রশংসনীয় হবে। মোহর সম্পর্কে আরো অনেক ভুল ধারণা আছে, যা দূর করা অতি প্রয়োজন।

মোহর মূলত একটি সম্মানী যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে, যার মূল উদ্দেশ্যই হল নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটা নারীর মূল্য নয় যে, তা পরিশোধ করলেই মনে করা যাবে, নারী নিজেকে স্বামীর হাতে বিক্রি করে দিয়েছে। তেমনি এ শুধু কথার কথাও নয়, যা শুধু ধার্য করা হয়, পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে নয়; বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সাথে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দিবে, যা তাকে সম্মানিত করে। এজন্য শরীয়তের তাকাযা হচ্ছে মোহর এত অল্পও নির্ধারণ না করা, যাতে মর্যাদার কোনো ইঙ্গিত থাকে না। আবার এত অধিকও নির্ধারণ না করা, যা পরিশোধ করা স্বামীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অন্যথায় হয়তো মোহর আদায় না করেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে, নতুবা জীবনের অন্তিম মুহূর্তে স্ত্রীর কাছে মাফ চাইতে বাধ্য হবে।

শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নারীর আসল হক ‘মোহরে মিছল’। ঐ নারীর বংশে তার মতো অন্যান্য নারীদের সাধারণত যে মোহর নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তার মোহরে মিছ্ল। যদি তার নিজের বংশে তার মতো আর কোনো নারী না থাকে, তাহলে অন্য বংশে তার সমপর্যায়ের নারীদের যে মোহর সাধারণত নির্ধারণ করা হয় সেটাই তার মোহরে মিছল। শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রী মূলত মোহরে মিছ্লের হকদার। এ কারণেই যদি মোহরের আলোচনা ছাড়া বিয়ে হয় কিংবা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহর নির্ধারিত না হয় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোহরে মিছল অবধারিত হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রে মোহরে মিছল পরিশোধ করা স্বামীর জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। তবে স্ত্রী নিজেই যদি সন্তুষ্টচিত্তে মোহরে মিছল হতে কম নিতে রাজি হয় অথবা স্বামী খুশি মনে মোহরে মিছল থেকে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করে তবে শরীয়তে এর অনুমতি আছে। অর্থাৎ উভয় পক্ষের সম্মতিতে মোহরে মিছল হতে কম-বেশি করেও মোহর নির্ধারণ করা যায়। আর এক্ষেত্রেও এমন কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই, যার বেশি মোহর ধার্য করা যায় না। তবে সর্বনিম্ন পরিমাণটি শরীয়তের নির্ধারিত। হানাফী মাযহাব মতে তা হচ্ছে দশ দিরহাম। দশ দিরহামের অর্থ, প্রায় দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা রূপা।

সর্বনিম্ন পরিমাণ মোহর নির্ধারিত থাকার অর্থ এই নয় যে, এত সামান্য পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তে প্রশংসনীয়; বরং উদ্দেশ্য হল, তার চেয়েও কম মোহরে স্ত্রী সম্মত হলেও শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ এর দ্বারা মোহরের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। তাছাড়া মোহরের এই সর্বনিম্ন পরিমাণও রাখা হয়েছে আর্থিকভাবে দুর্বল লোকদের কথা বিবেচনা করে, যাতে তারাও নারীর সম্মতির শর্তে এই পরিমাণ অর্থ দ্বারা বিবাহ করতে পারে। তাই একথা মনে করা মোটেও সঠিক নয় যে, শরীয়ত দু’ শ টাকা মোহর ধার্য করতে উৎসাহিত করেছে এবং এ অর্থে তা মোহরে শরয়ী। যারা এখন বত্রিশ টাকাকে মোহর নির্ধারণ করে সেটাকে শরীয়তসম্মত মোহর আখ্যা দিয়েছে তারা দুটি ভুল করেছে : প্রথম ভুল এই যে, দশ দিরহামের মূল্য কোনো যুগে হয়তো বত্রিশ টাকা ছিল, তারা সেটাকে সব সময়ের জন্য ধরে নিয়েছে। দ্বিতীয় ভুল হল শরীয়ত মোহরের যে সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করেছে, তার অর্থ তারা এই করেছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর চেয়ে অধিক মোহর নির্ধারণ করা অনুচিত। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যা হযরত ফাতেমা রা.-এর মোহর পাঁচ শত দিরহাম নির্ধারণ করেছিলেন, যা প্রায় ১৩১ তোলা তিন মাশা রূপার সমতুল্য। তেমনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে অনেকের মোহর এর কাছাকাছি নির্ধারণ করেছিলেন, যা মধ্যম পর্যায়ের হওয়ার কারণে একটি গ্রহণযোগ্য ও উপযুক্ত পরিমাণ।

অনেক লোক মোহরে ফাতেমিকে শরীয়তী মোহর বলে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণের মোহর নির্ধারণ করা অপছন্দনীয় তাহলে এই ধারণাও সঠিক নয়। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উভয় পক্ষ যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করে এবং মনে করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্ধারণ করা পরিমাণটি বরকতপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধায় তা গ্রহণ করা ভালো এবং এর মাধ্যমে সুন্নতের ছওয়াব লাভের প্রত্যাশা রয়েছে তাহলে এই আবেগ-অনুভূতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয় যে, মোহরে ফাতেমি এই অর্থে শরীয়তী মোহর যে, তার চেয়ে কম-বেশি করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়।

মোহর এই পরিমাণ হতে হবে, যা দ্বারা স্ত্রীকে সম্মানিত করা হয় এবং যা স্বামীর সামর্থ্যের চেয়ে বেশি না হয়। যেসব বুযুর্গ বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যও এই যে, সামর্থ্যের চেয়ে অধিক মোহর নির্ধারণ করা হলে তা একটি কাগুজে লেনদেনে পর্যবসিত হবে, বাস্তবে কখনো তা পরিশোধ করা হবে না। ফলে স্বামীর ঘাড়ে মোহর আদায় না করার গুনাহ থেকে যাবে। দ্বিতীয়ত অনেক সময় বড় অংকের মোহর নির্ধারণের পিছনে লোক দেখানোর মানসিকতাও কার্যকর থাকে। অনেকে শুধু নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানোর জন্যও অস্বাভাবিক বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করে। বলাবাহুল্য, এই দু’টো বিষয়ই ইসলামের স্বভাব-প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এ জন্যই অনেক বুযুর্গ অস্বাভাবিক বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে হযরত ওমর রা.-এর একটি ঘটনা স্মরণ রাখার মতো। হযরত ওমর রা. তাঁর খিলাফতের যুগে একবার ভাষণ দিলেন যে, কেউ যেন বিয়ে-শাদিতে বড় অংকের মোহর নির্ধারণ না করে। তখন এক মহিলা আপত্তি করে বললেন, কুরআন মজীদের এক জায়গায় তো এক কিনতার (সোনা-রূপার স্ত্তপ) মোহর দেওয়ার কথাও আছে, যা প্রমাণ করে যে, সোনা-রূপার স্ত্তপও মোহর হতে পারে। তাহলে বড় অংকের মোহর নির্ধারণে বাধা দিচ্ছেন কেন? হযরত ওমর রা. তাঁর কথা শুনে বললেন, বাস্তবেই তাঁর দলীল সঠিক। অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করা ঠিক নয়। এর অর্থ হল যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্য না থাকে এবং মোহর আদায় করার ইচ্ছা ও সামর্থ্যও থাকে তবে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা জায়েয। আর যদি কোনো একটি শর্তও অনুপস্থিত থাকে তবে সেক্ষেত্রে অত্যধিক মোহর নির্ধারণ করা জায়েয নয়।

প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে দুই ধরনের মোহরের প্রচলন রয়েছে। এক. مهر معجل (মোহরে মু‘আজ্জাল) বা নগদ মোহর। দুই.مهر مؤجل (মোহরে মুয়াজ্জাল) বা বাকি মোহর। এ শব্দগুলো যেহেতু বিয়ের মজলিস ছাড়া সচরাচর শোনা যায় না তাই অনেকে এ শব্দ দুটির অর্থ বুঝে না। শরীয়তের দৃষ্টিতে মোহরে মু‘আজ্জাল হল সেই মোহর, যা বিয়ে সম্পন্ন হওয়ামাত্র নগদ আদায় করা অপরিহার্য হয়ে যায়। হয়তো সে বিয়ের সময়ই তা পরিশোধ করে দিবে অথবা বিয়ের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর তা দাবি করার অধিকার আছে। যেহেতু আমাদের সমাজে নারীরা সাধারণত মোহর দাবি করে না তাই এরূপ মনে করা উচিত হবে না যে, সেটা পরিশোধ করা আমাদের জন্য জরুরি নয়; বরং কর্তব্য হল স্ত্রীর চাওয়ার অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব এই ফরয দায়িত্ব হতে মুক্ত হওয়া।

মোহরে মুয়াজ্জাল বলা হয় সেই মোহরকে, যা পরিশোধের জন্য উভয় পক্ষ কোনো তারিখ নির্ধারণ করে। ঐ তারিখ আসার আগে মোহর আদায় করা স্বামীর জন্য আবশ্যকীয় নয়। স্ত্রীও সেই তারিখের আগে এই মোহর দাবি করতে পারবে না। সুতরাং মোহর মুয়াজ্জাল হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বিয়ের দিনই তা পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা হবে, কিন্তু আমাদের সমাজে সাধারণত কোনো দিন-তারিখ নির্ধারণ না করে শুধু এটুকু বলে দেওয়া হয় যে, এই পরিমাণ মোহরে মুয়াজ্জাল (বাকি মোহর)। আর সামাজিক প্রচলন অনুযায়ী তার অর্থ দাঁড়ায়, তা পরিশোধ করা হবে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে কিংবা স্বামী-স্ত্রী কারো মৃত্যু হলে। এটিও একটি ভুল প্রচলন।

আরেকটি বিষয় হল, স্বামীর পক্ষ হতে নববধুকে যে গয়নাগাটি দেওয়া হয় মোহরের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক নেই। আমাদের সামাজিক প্রচলন মতে স্ত্রী এই অলংকারের মালিক হয় না; বরং সেগুলো তাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। ফলে স্ত্রী সেই অলংকার স্বামীর অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারে না এবং কাউকে উপহারও দিতে পারে না। আর এ কারণেই-আল্লাহ না করুন-তালাকের ঘটনা ঘটলে স্বামী তা ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের অলংকার দ্বারা মোহর আদায় হয় না। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে স্পষ্টভাবে বলে যে, আমি এই অলংকার মোহরস্বরূপ তোমাকে দিয়েছি এবং তুমি এর মালিক তাহলে সেই অলংকার মোহর হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ঐ অলংকারের উপর স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই তা স্ত্রীর নিকট থেকে ফেরত নেওয়া যাবে না।

যাই হোক, মোহর নির্ধারণের বিষয়টি নিছক কথার কথা বা ঐচ্ছিক কোনো আচার পালনের বিষয় নয়; বরং তা একটি ফরয বিধান ও গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী দায়িত্ব, যা পূর্ণ মনোযোগ ও বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ লেনদেন। অতএব এর যাবতীয় দিক শরীয়ত অনুযায়ী ও পরিষ্কারভাবে হওয়া উচিত এবং সে হিসেবেই তা পরিশোধের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। এটি বড়ই অন্যায় কথা যে, সারা জীবন উদাসীন থেকে মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীর নিকট মাফ চাওয়া হয়, যখন পরিস্থিতির চাপে স্ত্রীরও মাফ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

[‘‘যিকর ও ফিকর'' থেকে গৃহীত ও অনুদিত। অনুবাদ : আনসারুল্লাহ হাসান]

1 Comments

Post a Comment

Previous Post Next Post