হে বন্ধু! আত্মহত্যাই কি একমাত্র সমধান? এটাই কি মুক্তির একমাত্র পথ? হে বন্ধু যখনই তোমার মনে কোনো কষ্ট অনুভব হয়, তুমি হতাশ হয়ো না। তুমি আস্থা রাখো তোমার মহান রবের প্রতি, যিনি তোমার সমুদয় কষ্ট দূর করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তুমি একনিষ্ঠভাবে ফিরে আসো তোমার প্রতিপালকের দিকে, তিনি তোমার হৃদয়ের যাবতীয় অশান্তি দূর করে তোমার হৃদয়কে প্রশান্ত করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি পরম দয়ালু, পরম ক্ষমাশীল।
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন
হে আমার বান্দাগন! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তামাম গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু’’ [যুমার ৩৯/৫৩]
মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেদেরকে ধ্বংস করতে তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে নিষেধ করেছেনঃ
তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং সহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না এবং কল্যাণকর কাজ করে যাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ কল্যাণকারীদের ভালবাসেন’’ বাকারাহ ২/১৯৫
হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসায় বৈধ। এবং নিজেদের ধংস ডেকে এনো না কিংবা তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি অতি দয়ালু’’ [নিসা ৪/২৯]
রাসুল (সাঃ) আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়েননি
জাবির ইবন সামুরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ)-এর নিকট জনৈক ব্যক্তির লাশ উপস্থিত করা হল। সে তীরের আঘাতে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু রাসুল (সাঃ) তার জানাজার সলাত আদায় করেননি’’ [মুসলিম ১৬২৪-(১০৭/৯৭৮); তিরমিযি ১০৬৮; ইবন মাযাহ ১৫২৬; আবু দাউদ ৩১৮৫; বুলুগুল মারাম ৫৫৫]
নোটঃ আত্মহত্যাকারীর জানাজা ইমাম সাহেব আদায় করবেন না। অন্যান্য সাধারন লোকদের জন্য আত্মহত্যাকারীর জানাজার সলাতে অংশগ্রহন করা জায়েয।
আত্মহত্যাকারীর অন্যান্য নেক আমল কবুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন হুনাইনের যুদ্ধে আমরা রাসুল (সাঃ) এর সাথে ছিলাম। তিনি এক ব্যাক্তিকে জাহান্নামী বলে চিহ্নিত করলেন, যে আমাদের মাঝে মুসলিম হিসাবে পরিচিত ছিল। যখন আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হলাম, ঐ লোকটি ভীষণভাবে যুদ্ধ করলো, সে আহত হয়ে গেল। এ সময় কেউ এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! কিছুক্ষন আগে আপনি যার সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘সে জাহান্নামী’ আজ সে ভীষণভাবে জিহাদ করে মারা গেছে।এ কথা শুনে নাবী (সাঃ) বললেন, সে জাহান্নামে চলে গেছে। কিন্তু এতে কোনো কোনো মুসলিম সন্দেহে পতিত হল। ইত্যবসরে কেউ এসে বলল, লোকটি মরেনি, তবে সে মারাত্মকভাবে আহত।
পরে যখন রাত হল, সে জখমের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। নাবী (সাঃ)-কে এ সংবাদ জানানো হল।তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি নিশ্চিত আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল। অতঃপর তিনি বিলাল (রাঃ)-কে ঘোষণা করতে নির্দেশ দিলেনঃ ‘মুসলিম ব্যাতিত কোনো ব্যাক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা পাপী ব্যাক্তির দ্বারাও এ দ্বীনের সাহায্য ও শক্তি প্রদান করবেন’’ [মুসলিম ১৭৮-(১১১)]
সাহল ইবন সা’দ আস সাঈদী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে একবার রাসুল (সাঃ) তাঁর সেনাবাহিনীর দিকে অগ্রসর হলে অপরপক্ষও তাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হল। রাসুল (সাঃ)-এর সঙ্গীদের মধ্যে সে সময় এমন এক ব্যাক্তি ছিল, যে সেদিন বীরত্বের সাথে লড়েছিল। কোনো কাফিরকে দেখামাত্র সে তার পিছনে লেগে যেত এবং তরবারি দ্বারা খতম করে দিতো। লোকেরা তার বীরত্ব দেখে বলাবলি করছিল যে, অমুক ব্যাক্তি আজ যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, আমাদের কেউ তা পারেনি। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ মনে রেখ! সে ব্যাক্তি জাহান্নামী।উপস্থিত লোকদের একজন বলল, আমি সর্বক্ষণ তার সাথে থাকবো। তারপর সে ব্যাক্তি তার পিছনে থাকলো। যেখানে সে থামত সেও তথায় থেমে যেত। যখন সে দ্রুতবেগে কোথাও যেত, সেও তার সাথে তথায় দ্রুত গমন করতো।
শেষ পর্যন্ত যে ব্যাক্তি মারাত্মকভাবে যখম হল। তারপর ক্ষতের জ্বালার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে ত্বরায় মৃত্যু কামনা করলো। সে তার তরবারি যমীনে রেখে এর অগ্রভাগ তার উভয় স্তনের মাঝামাঝি ঠেকিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়ল এবং নিজেকে হত্যা করলো।তাকে অনুসরণকারী লোকটি রাসুল (সাঃ)-এর কাছে গেল এবং সাক্ষ্য প্রদান করলো, নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসুল। তিনি বললেন, ব্যাপার কি? সে বলল, আপনি একটু আগে যে ব্যাক্তিকে জাহান্নামী বলেছিলেন এবং লোকেরা এতে আশ্চর্য হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমি তার সাথে থেকে তোমাদেরকে খবর দিব। আমি অপেক্ষায় থাকলাম। অবশেষে সে মারাত্মকভাবে আহত হল এবং দ্রুত মৃত্যুর জন্য নিজের তরবারি যমীনে রেখে এর অগ্রভাগ তার উভয় স্তনের মাঝামাঝি ঠেকিয়ে দিলো। তারপর এর উপর ঝুঁকে পড়ল এবং নিজেকে হত্যা করলো।এ কথা শুনে রাসুল (সাঃ) বললেনঃ ‘’লোকের দৃষ্টিতে কোনো ব্যাক্তি জান্নাতের কাজ করছে অথচ সে জাহান্নামী হয়, আবার লোকের দৃষ্টিতে কোনো ব্যাক্তি জাহান্নামের কাজ করছে অথচ সে জান্নাতবাসী’’ [মুসলিম ১৭৯-(১১২)]
আত্মহত্যাকারীর পরকালে ক্ষমা পাওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ
হাজ্জাজ ইবন মিনহাল (রহঃ) বলেন, জারীর ইবন হাযিম (রহঃ) আমাদের হাদীস শুনিয়েছেন হাসান (রহঃ) হতে, তিনি বলেন, জুনদাব (রাঃ) এই মসজিদে আমাদেরকে হাদীস শুনিয়েছেন।, আর আমরা তা ভুলে যাইনি এবং আমরা এ আশংকাও করিনি যে, জুনদাব (রাঃ)-এর নামে মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তির (দেহে) জখম ছিল, সে আত্মহত্যা করলো। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার বান্দা তার প্রান নিয়ে আমার সাথে তাড়াহুড়া করলো। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম’’ বুখারী ১৩৬৪
নোটঃ এটা ধমক স্বরূপ, কেননা কবীরা গুনাহের জন্য জান্নাত হারাম হয় না। বরং শিরকে আকবার ও কুফরী অবস্থায় বিনা তাওবায় মারা গেলে জান্নাত হারাম হয়।
জুনদাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ ‘’পূর্ব যুগের এক ব্যক্তির ফোঁড়া হয়েছিল। ফোঁড়ার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে, তার তূন থেকে একটি তীর বের করলো। আর তা দিয়ে আঘাত করে ফোঁড়াটি চিরে ফেলল। তখন তা থেকে সজোরে রক্তক্ষরণ শুরু হল, অবশেষে সে মারা গেল। অতঃপর তোমাদের প্রতিপালক বলেন, আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি’’ [মুসলিম ১৮০-(১১৩)]
আত্মহত্যাকারীর পরকালিন শাস্তিঃ
সাবিত ইবন যাহহাক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্যকোন ধর্মের (অনুসারী হবার) মিথ্যা হলফ করলো, সে যেমন বলল, তেমনই হবে। আর যে ব্যক্তি কোনো ধারালো লোহা বা অন্য যেকোনো অস্ত্র) দ্বারা আত্মহত্যা করলো, তাকে তা দিয়েই জাহান্নামে আযাব দেয়া হবে’’ [বুখারী ১৩৬৩, ৬০৪৭, ৬১০৫, ৬৬৫২; মুসলিম ১৭৬-(১১০), ১৭৭(...)]
সাবিত ইবন যাহহাক (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’যে ব্যক্তি কোনো বস্তু দ্বারা নিজেকে যবেহ করবে, কিয়ামত দিবসে উক্ত জিনিস দ্বারা তাকে যবেহ করা হবে’’ মুসলিম ১৭৭(...)আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরুপভাবে নিজেকে ফাঁস লাগাতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরুপভাবে বর্শাবিদ্ধ হতে থাকবে’’ বুখারী ১৩৬৫
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’যে লোক পাহাড়ের উপর (অথবা যেকোন উচু স্থান) হতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে, চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ঐভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোক লোহার আঘাতে (অথবা যেকোন অস্ত্র দ্বারা) আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের ভিতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে’’ [বুখারী ৫৭৭৮]
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’যে ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে সেই অস্ত্র দ্বারা নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে, এভাবে সে তথায় চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অবস্থান করে উক্ত বিষপান করতে থাকবে, এভাবে সে তথায় চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড় থেকে (অথবা যেকোন উচু স্থান হতে) নীচে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি সর্বদা পাহাড় থেকে নীচে গড়িয়ে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকবে, এভাবে সে তথায় চিরকাল শাস্তি পেতে থাকবে’’ [মুসলিম ১৭৫-(১০৯)]
হে বন্ধু! ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ায় সুখ-দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদি থাকবেই। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে উত্তরনের পথ বের করার প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়। একজন মুসলিম উচিৎ নয় দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার জন্য তাড়াহুড়া করা। আবু ইয়াহইয়া সুহাইব ইবন সিনান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’মু’মিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক! তার প্রতিটি কাজে তার জন্য মঙ্গল রয়েছে। এটা মু’মিন ব্যতিত অন্য কারো জন্য নয়। সুতরাং তার সুখ এলে সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ পৌছলে সে ধৈর্যধারণ করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’’ [মুসলিম ২৯৯৯; রিয়াদুস সালিহীন ২৮]
লিখেছেন: আনিসুর রহমান
Post a Comment