তারাদের গল্প বলি। অবশ্য এ গল্প শুরু করলে তো শেষ হবে না।
কাকে দিয়ে শুরু করা যায়? Sirius-কে দিয়েই না হয় শুরু করি। বাংলায় একে বলে ‘লুব্ধক তারা’। রাতের আকাশে এই তারাটাকে দেখতে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায়! খালি চোখে দেখা না গেলেও এটা মূলত দুইটা তারার সমষ্টি। একটির নাম Sirius-A। অপরটির নাম Sirius-B। Sirius-A সূর্য থেকে প্রায় দ্বিগুণ বড়। খুব একটা বড় মনে হচ্ছে না? খালি চোখে দেখলে সূর্য তো ছোট একটা বৃত্তের মতো। কিন্তু আসলেই কি তাই?
.
আমাদের পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬৩৭১ কিলোমিটার। এমন বারোলক্ষ পৃথিবী এক সাথে করলে তা সূর্যের সমান হবে। অবশ্য সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের তুলনায় সূর্য কিছুই না। সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের নাম VY Canis Majoris। পৃথিবী থেকে প্রায় ৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই নক্ষত্রটি সূর্য থেকে প্রায় ১৫৪০ গুণ বড়। অন্যদিকে, Sirius আমাদের পৃথিবী থেকে ৮.৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আলোকবর্ষ মানে যেন কী?
আলোকবর্ষ মানে আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে। এক বছর বাদ দেই, আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করে। যার অর্থ আলো এক সেকেন্ডে প্রায় ৬৩৮ বার ঢাকা থেকে সিলেট যেয়ে আবার ঢাকায় ফেরত আসতে পারবে।
সবারই নিতান্ত শখের বশে হলেও মাঝে মাঝে এস্ট্রোনমি নিয়ে পড়াশুনা করা উচিৎ। দেখবেন মনের ইগো অনেক কমে যাবে। এই “Infinitely Finite” ইউনিভার্সের সাপেক্ষে চিন্তা করলে যদি পৃথিবীকে বলি, “অসীম সমুদ্রে এক ফোঁটা জল”- একটুও বাড়াবাড়ি হবে না। আমরা সেখানে কোন ছাড়!
.
আপনি যেই পাড়ায় থাকেন, তা আপনাদের গ্রামের তুলনায় খুবই ছোট। গ্রামটা আবার থানার তুলনায় অনেক ছোট। আবার পুরো জেলা হিসেবে চিন্তা করলে থানাটা কিছুই না। তারপর আসে বিভাগ-দেশ-মহাদেশ-আমাদের চেনা পৃথিবী। একবার ভাবুন তো পুরো পৃথিবীর কথা চিন্তা করলে আপনার চেনা জগতটা ঠিক কতোখানি ছোট? হিসেবটা এখানেই শেষ না। এরপর আছে-
.
Solar System: পুরো সোলার সিস্টেমের ভরের তুলনায় পৃথিবীর ভর কেবল ০.০০০৩%।
.
Solar Interstellar Neighborhood: প্রায় ৫৩ টা সোলার সিস্টেম নিয়ে গঠিত। আমাদের লোকাল সোলার ইন্টারসেলারকে অতিক্রম করতে লাগবে প্রায় ৩০ আলোকবর্ষ।
.
Galaxy: আমাদের গ্যালাক্সীতে প্রায় ৪০০,০০০,০০০,০০০(চারশো বিলিয়ন) সংখ্যক সূর্যের মতো তারা আছে। মিল্কিওয়ে একটি মাঝারি আকারের গ্যালাক্সী বা ছায়াপথ। সবচেয়ে বড়ো গ্যালাক্সী IC-1101 এ রয়েছে ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০(একশো ট্রিলিয়ন) সংখ্যক তারা।
.
The Local Group: আমাদের লোকাল গ্রুপে রয়েছে প্রায় ৪৭ টার মতো গ্যালাক্সি। লোকালগ্রুপকে বলা হয় গ্যালাক্সিগুচ্ছ(Galaxy cluster)। একটা বড়ো ধরনের cluster এ শত শত গ্যালাক্সী থাকতে পারে। আমাদের সোলার সিস্টেমের তুলনায় লোকাল গ্রুপ প্রায় ৫ মিলিয়ন গুণ বড়ো।
.
The Supercluster : একটা supercluster এ শত শত cluster থাকতে পারে। আমাদের Supercluster টির নাম “The Pisces-Cetus Supercluster Complex”- এখানে রয়েছে প্রায় ৬০টির মতো supercluster। আমাদের ডাটা অনুযায়ী The Pisces-Cetus Supercluster Complex এ প্রায় ৩৫,০০০ এরও বেশী গ্যালাক্সী রয়েছে।
.
The Observable Universe: এতে রয়েছে ১০ বিলিয়ন supercluster। ৩৫০ বিলিয়ন গ্যালাক্সী। আর কতোগুলো তারা থাকতে পারে সূর্যের মতো কল্পনা করতে পারেন?
আনুমানিক ৩০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ সংখ্যক।
পৃথিবীর মতো গ্রহ কয়টা থাকতে পারে? সেটা তো অনুমান করতেও কষ্ট হয়।
.
এরপর অনেকে নিয়ে এসেছে “Multiverse theory”। যে থিওরী অনুসারে, এই অসীম সংখ্যক গ্রহগুলো নিয়ে গড়া আমাদের Observable Universe আসলে পুরো ইউনিভার্সের তুলনায় কেবল একটা বাবলের মতো। যেমনটা বলেছিলাম- “বিশাল সমুদ্রে এক ফোঁটা জল”।
.
এই অসীম মহাবিশ্ব আপনাকে শিখাবে এর স্রষ্টার বিশালত্ব, দেখবেন মাথা আপনা-আপনি বাধ্য হবে তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদা দেয়ার জন্য। তবে আপনি অন্ধ হলে ভিন্ন কথা। তখন ভাবা শুরু করবেন- এই বিশাল মহাবিশ্ব আপনাআপনি শুন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যেমনটা আল্লাহ অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে বলেন-
“তারা কি শুন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিকর্তা? নাকি তারা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছে? বরং, তাদের কোনো সঠিক বিশ্বাস নেই।" (কুর’আন ৫২:৩৫-৩৬)
.
আবার Sirius এর কাছে ফিরে যাই। Sirius কে আরবে ‘মারযামুল জাওযা’ বলা হতো। জাহেলী যুগে আরবরা এর উপাসনা করতো। কুরাইশদের প্রতিবেশী খুজা’আ গোত্র এর উপাসনার জন্য বিখ্যাত ছিলো। তারা বিশ্বাস করতো, এই তারার আমাদের ভাগ্যের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রয়েছে। মিশরবাসীরাও এর উপাসনা করতো। কারণ, এর উদয়কালে নীলনদে জোয়ার ও প্লাবন হতো। আল্লাহতায়ালা তাই কুরআনে নাযিল করলেন-
“আল্লাহতায়ালাই হচ্ছেন Sirius এর রব।” (৫৩:৪৯)
.
মেসেজটা খুব ক্লিয়ার- Sirius এর বিশালত্বে মুগ্ধ হয়ে এটার ইবাদত না করে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। কারণ, আল্লাহতায়ালাই এর সৃষ্টিকর্তা।
.
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ । তোমরা না সূর্যকে সিজদা করবে, না চাঁদকে। আর তোমরা আল্লাহকে সিজদা করো যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন- যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদাত করে থাকো।” (কুর’আন ৪১:৩৭)
.
আকাশের তারাগুলো হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার এক অসাধারণ নিদর্শন। আমরা যখন আকাশের তারাদের দিকে তাকাবো, তখন আমাদের করুণাময় আল্লাহ্র কথা মনে হবে। তাদের নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান আমাদের জানিয়ে দেয় অবশ্যই এদের একজন স্রষ্টা রয়েছেন। এ কারণেই হয়তো পবিত্র কুর’আনে একটি সূরার নাম দেয়া হয়েছেঃ “আন-নাজম”। যার অর্থ "তারা"।
.
একবার এক লোক এক আরব বেদুঈন নারীকে রাতের বেলা একা পেয়ে গেল। সে বারবার মেয়েটাকে তার সাথে মিলিত হতে প্ররোচিত করতে লাগল। একসময় মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বলল-
.
أي ثكلتك أمك أمالك زاجر من كرم ؟ أمالك ناه من دين ؟
“ তোমার কি সমস্যা? কোথায় তোমার সম্মান? তোমার দ্বীন?”
লোকটা মজা করে জবাব দিল-
والله لا يرانا إلا الكواكب
“সখী! কেউই তো আমাদের দেখছে না, আকাশের ঐ তারাগুলো ছাড়া।”
.
লোকটাকে স্তম্ভিত করে মহিলাটি জবাব দিল-
وأين مكوكبها ؟
“ আর তাঁর ব্যাপারে কি বলবে যিনি তারাগুলোকে আকাশে স্থাপন করেছেন?” (শুয়াবুল ঈমান)
--------------------------------------------
--------
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন
অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ Click Here এবং Click Here
ফেসবুক পেজঃ Click Here
সুবহানাল্লা,আল্লাহু আকবর।
ReplyDeletePost a Comment