কুরআনে কেন বার বার শপথ করা হয়েছে?


#নাস্তিক_প্রশ্ন: কোন কথা আস্থাযোগ্য না হলেই মানুষ শপথ করে/কসম কাটে! তবে কেন আল্লাহকে কুরানে এতোবার কসম কাটতে হলো (Quran 57:1-4, 52:1-6, 53:1, 56:75, 70:40, 74:31-34, 84:16-18, 92:1-3, 95:1-3…………… ইত্যাদি)?
.
উত্তরঃ ইমাম জালালুদ্দিন মহল্লী রাহ (মৃ-৮৬৪হি) এই বিষয়ে লিখেন,
.
“ তবে সাধারনত যে বস্তুর শপথ করা হয়, তার কিছু না কিছু প্রভাব সে বিষয়বস্তু প্রমানে অবশ্যই থাকে, যার জন্য শপথ করা হয়। প্রতিটি শপথের কথা চিন্তা করলে এ প্রভাব সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।”
.
[তাফসীরে জালালাইন, ইসলামিয়া কুতুবখানা, ৫/৩৯৩]

.
মাওলানা তাকী উছমানী এই প্রসঙ্গে লিখেন,
.
“ ………………………………. এক, নিজের কোন কথা বিশ্বাস করানোর জন্য আল্লাহ তা’আলার কোন কসম করার প্রয়োজন নেই। নিজের কোন কথা সম্পর্কে কসম করা হতে তিনি বেনিয়ায। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন স্থানে যে বিভিন্ন কসম করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য কথাকে সৌন্দর্যমন্ডীত, অলংকারপূর্ণ ও বলিষ্ঠ করে তোলা। অনেক সময় এ দিকটার প্রতি লক্ষ্য থাকে যে, যেই জিনিসটার কসম করা হচ্ছে, তার কিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে তার পরবর্তীতে যে বক্তব্য আসছে তা তার সত্যতার প্রমান বহন করে।”
.
[তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, মাকতাবাতুল আশরাফ, ৩/৪০৬]
.
অন্যস্থানে তিনি লিখেন,
.
“ মুফাসসিরগন বলেন, শপথ হচ্ছে আরবী ভাষালঙ্কারের একটি বিশেষ শৈলী। এর দ্বারা কথা শক্তিশালী হয়, কথায় আসর হয়”
.
[তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ৩/১৫৮]
.
মাওলানা আমিন আহসান এসলাহী লিখেন,
.
“ কুরআনে উল্লেখিত আল্লাহর এই শপথগুলো দ্বারা শপথকৃত বস্তুকে শ্রদ্ধা বা সম্মান জানানো হয়না বরং কোনো দাবির স্বপক্ষে প্রমান উপস্থাপন করা হয়ে থাকে”
.
[ Tadabbur-e-Quran, Mawlana Amin Ahsan Eslahi, exegesis of Surah Saffat]
.
“ আমি আমার শিক্ষক মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহীর “আকসামুল কুরআন” এর গবেষনার কিছু উল্লেখ করেছি যেখানে তার মতামত হচ্ছে কুরআনের বেশীর ভাগ শপথগুলোই সেই সূরারই কোনো আয়াতের স্বপক্ষে প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে”
.
[ Tadabbur-e-Quran, Mawlana Amin Ahsan Islahi, exegesis of Surah Tur]
.
একটু গভীর পর্যবেক্ষন করা যাক, ইনশাআল্লাহ-
.
শপথ তাদের যারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো, অতঃপর ধমকিয়ে ভীতি প্রদর্শনকারীদের, অতঃপর মুখস্থ আবৃত্তিকারীদের, নিশ্চয় তোমাদের মাবুদ এক। (সূরা সাফফাত ৩৭ঃ১-৪)
.
এই আয়াতে প্রথমেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কারো শপথ করা হচ্ছে; এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিররা বলেন, তারা হলেন ফেরেশতারা।
.
[তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ৩/১৫৮, তাফসীরে জালালাইন,৫/৩৯০]
.
এখানে ফেরেশতাদের শপথ করার কারন হিসেবে বলা যেতে পারে যে, মক্কার মুশরিকরা কেউ কেউ ফেরেশতাদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কন্যা বলে অভিহিত করত আবার কেউ কেউ তাদেরকেই ইবাদাত করত আবার কেউ কেউ তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করত(নাউযুবিল্লাহ), তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফেরেশতাদের এইসব গুনাবলী তারা সারিবদ্ধভাবে আল্লাহর ইবাদাত করেন বা আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য সারিবদ্ধরুপ থাকেন, তারা শয়তাদের বিরুদ্ধে বাধা সৃষ্টি করে আর তারা আল্লাহর জিকরে ব্যস্ত থাকেন, যার মাধ্যমে প্রমান হয় যে, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা নয় বা ফেরেশতাদের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই যে তাদের ইবাদাত করা যায় বরং তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার একান্ত অনুগত দাস ছাড়া কিছু নয়। এর মাধ্যমে সূক্ষ্ণ শিরককে খন্ডন করা হয়েছে এর বিপরীতে ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে “ নিশ্চয়ই তোমাদের মাবুদ এক” অর্থাৎ প্রথম ৩ আয়াতে মুশরিকদের যুক্তি খন্ডন ও ফেরেশতাদের দাসত্বমনা প্রমান করে ৪ নং আয়াতে আল্লাহর তাওহীদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
.
[(তাফসীরে জালালাইন, ৫/৩৯২), (Tadabbur-e-Quran, explanation of this ayat), তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ৩/১৫৮-৫৯)]
.
এরপরে সূরা তূরের দিকে যাওয়া যাক-
.
কসম তূরপর্বতের, এবং লিখিত কিতাবের,যা লিখিত আছে প্রশস্ত পত্রে, কসম বায়তুল-মামুর তথা আবাদ গৃহের, এবং সমুন্নত ছাদের, এবং উত্তাল সমুদ্রের, আপনার পালনকর্তার শাস্তি অবশ্যম্ভাবী (সূরা তূর ৫২ঃ১-৭)
.
এই আয়াতগুলোতে ৫টি বস্তুর শপথ করা হয়েছেঃ-
.
(১) তূর পর্বতের যেখানে মুসা(আ)কে নবুওয়াত ও তাওরাহ কিতাব দেওয়া হয়েছিলো;
.
(২) লিখিত কিতাব যা লিখা আছে প্রশস্ত পত্রে বলতে এখানে তাওরাহকে অথবা প্রত্যেকের আমলনামাকে বুঝানো হচ্ছে;
.
(৩) বায়তুল মামূর যা সপ্তম আকাশে ফেরেশতাদের ইবাদাতঘর
.
(৪) সমুন্নত ছাদ ; অর্থাৎ আকাশকে বুঝানো হচ্ছে;
.
(৫) উত্তাল সমুদ্র;
.
তারপরই ৭নং আয়াতে আল্লাহর আযাবের কথার বর্ণনা এসেছে অর্থাৎ কিয়া্মত দিবসের স্মরণ।
.
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, প্রথমদিকে তূর পাহাড়ের শপথ করা হয়েছে যেখানে মুসা(আ)কে নবুওয়াত দেওয়া হয়েছিলো ও তাওরাহ কিতাব দিয়েছিলেন। আখিরাত দিবস যে অবশ্যম্ভাবী, তা পূর্ববর্তী সব কিতাবেই ছিলো সেই প্রসঙ্গে মুসার(আ) উপর অবতীর্ন কিতাবের শপথ করা হয়েছে; তারপর লিখিত কিতাবের শপথ করা হয়েছে যা দ্বারা তাওরাতকে বুঝানো হলে উপরের আয়াতের প্রসঙ্গেই তাওরাত কিতাবকে উল্লেখ করা হয়েছে অথবা যদি মানুষের আমলনামাকে ধরা হয় তবে মানুষের আমলনামা লিখার কাজ প্রতিনিয়তই চলছে তা যদিও কেউ না জানুক বা সকলেই দৃষ্টির অন্তরালে আর একদিন এই আমলনামা প্রকাশিত হবে সকলের সামনে যা কিয়ামত দিবসের অপরিহার্যতাকে প্রমান করার জন্য জোরালো দলিল,তারপর বায়তুল মামুরের শপথ করা হয়েছে যা ফেরেশতাদের ইবাদাতখান, ফেরেশতারা যদিও
কোনো বিচারের প্রতিক্ষীত নন তবুও তারা ক্লান্তিহীনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করে চলছেন আর সেখানে মানুষজাতি যাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা আবশ্যক করা হয়েছে তারা দিব্যি আখিরাতকে ভুলে আল্লাহর আদেশ নিষেধ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার সুখ-বিলাসিতায় মত্ত হয়ে আছে। তারপরে আল্লাহ এই পৃথিবীতে তার দুটি বড় নিদর্শন মহাকাশ যা লক্ষ-কোটি নক্ষত্র-নীহারিকায় পরিপূর্ণ আর সাগর যেখানে আছে হাজার হাজার প্রজাতির প্রানী যাদেরকে পানির নিচে বাচিয়ে রাখা হয়েছে যার বৈচিত্র্য মানবহ্রদয়কে বিস্ময়ে হতবিহবল করে অর্থাৎ এই নিদর্শনের উল্লেখ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে তাদের বোধোদয়ের জন্য, যাতে আল্লাহর এইসব মহান নিদর্শনকে দেখে বুঝা যায় যে এতকিছু তিনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি, এর একদিন সমাপ্তি ঘটবে, আর যিনি এই অকল্পনীয় বৈচিত্র্যময় পৃথিবী আর মধ্যেকার সবকিছুর স্রষ্টা তিনি সবকিছুর সমাপ্তির পরেও সবকিছুকে একত্রিত করতে পারেন আর হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন করতে সক্ষম। তারপরে আল্লাহর আযাবের অপ্রতিরোধ্য আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন যা যোগ্যদেরকে ঠিকই পাকড়াও করবে এমন এক দিনে যেই দিনকে তারা ঘৃনাভরে ও অহমিকাবশত অস্বীকার করেছিলো।
.
[(তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ৩/৪১৭-১৮),(Tadabbur-e-Quran,explanation of SUrah Nazm)]
.
আবার সূরা ইনশিকাকের শপথের দিকে লক্ষ্য করা যাকঃ
.
আমি শপথ করি সন্ধ্যাকালীন লাল আভার , এবং রাত্রির, এবং তাতে যার সমাবেশ ঘটে, এবং চন্দ্রের, যখন তা পূর্ণরূপ লাভ করে, নিশ্চয় তোমরা এক সিঁড়ি থেকে আরেক সিঁড়িতে আরোহণ করবে। (সূরা ইনশিকাক ৮৪ঃ১৬-১৯)
.
এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এখানে রক্তিম লাল আভার, রাত্রি ও রাত্রি যা ধারন করে এবং চাদের শপথ করেছেন, এর রহস্য হিসেবে বলা যায় যে, সন্ধ্যাকে সাধারনত দিনের শেষ হিসেবে ধরা হয় যখন দিনের আভা নিষ্প্রভ হয়ে যায় আর তার স্থানে জায়গা নেয় সন্ধ্যা,আর রাতে যখন ওই আকাশে ওঠে চাঁদ যা তার সৌন্দর্যে ভুবন আলোকিত করে। এসবকিছুই আল্লাহর নির্দেশে নিজেদের নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের পরে নিষ্প্রভ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তেমনি মানুষ ও শুক্র থেকে কৈশোর, যৌবন, মধ্য ও বার্ধক্য ইত্যাদি নানা পর্যায়ের সম্মুখীন হয়। চাঁদ যেমন আল্লাহর অনুমতিতেই তার নির্দিষ্ট সময় রাতের পরে সূর্যকে জায়গা করে দেয় ভুবন আলোকিত করার জন্য তেমনি সূর্য ও দিনশেষে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে তেমনি মানুষও তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায় শেষে আল্লাহর অনুমতিতে তার নিকটেই ফিরে যাবে।
.
[ (তাফসীরে জালালাইন, ৭/৪০১-০২), (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ৩/৬৯২), (Tadabbur-e-Quran, explanation of Surah Inshiqaq, p-9)]
সুতরাং বলা যায়, কুরআনুল কারীমের শপথগুলো মোটেও কুরআনের ত্রুটি নয় কলেবর বড় হওয়ার আশঙ্কায় তা এখানে লেখা হলো না; এমন করে প্রতিটি আয়াত গভীর পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে পাঠ করলে লক্ষ্য করা যাবে যে যেসব সূরাতেই এমন কোনো শপথ এসেছে তাতে অবশ্যই কোনো না কোনো সম্পর্ক পরের আয়াতের সাথে রয়েছে। বলা যায় এটি কুরআনুল কারীমের লুকায়িত সৌন্দর্য রয়েছে যা এই পৃথিবীতে শূধুমাত্র কুরআনুল কারীমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নিসন্দেহে এই শপথগুলো আল্লাহর কালাম কুরআনুল মাজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য বা মুযিজাহ, পাঠক যখনই এর দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করবে নিরপেক্ষ মন নিয়ে সে অবশ্যই এতে হেদায়েতের আলো দেখতে পাবে।
.
এই বিষয়ে মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহীর বিখ্যাত একটি বই আছে “আল ঈমান ফি আকসামুল কুরআন” যার ইংরেজী অনুবাদের লিংক নিম্নে দেওয়া হলো আগ্রহীগন পড়ে নিতে পারেন।
পড়ুন অথবা ডাউনলোড করুন
.
=====================
লেখকঃ হোসাইন শাকিল

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ shottokothon.com  এবং response-to-anti-islam.com

ফেসবুক পেজঃ fb.com/shottokothon1

Post a Comment

Previous Post Next Post