গত প্রায় দু’বছরে নাস্তিকতা নিয়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। ইসলামবিদ্বেষীদের বিভিন্ন অবান্তর প্রশ্ন, অপবাদ ও সৃষ্ট সংশয়ের জবাব দেয়া হয়েছে। এখনো হচ্ছে। সার্বিকভাবে বিষয়টি ইতিবাচক। ইসলামের সমর্থনে তরুণরা এগিয়ে আসছেন, সময় ও শ্রম দিচ্ছেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনেক লেখক বের হয়ে আসছেন। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্রমাগত চলতে থাকে সিস্টেম্যাটিক এবং সিস্টেমিক ইসলামবিদ্বেষের ফলে মুসলিমদের আত্মবিশ্বাসে যে আঘাত লেগেছিল সামান্য হলেও সেটার মেরামত করা হচ্ছে – এগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় দিক। তবে মুসলিম সমাজের বিশ্বাস, কাজ ও আদর্শের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে “ইসলামবিদ্বেষীদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব ও অভিযোগের খণ্ডন” – এর গুরুত্ব কতোটুকু, সার্বিক বিচারে এ কাজটির অবস্থান কোথায় – এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আমাদের সঠিক ও পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।
নাস্তিকদের অভিযোগ খণ্ডন মূলত একটি প্রতিক্রিয়া। ইসলামবিদ্বেষীরা আক্রমণ করছে, এটা ক্রিয়া। আমরা জবাব দিচ্ছি এটা হল, প্রতিক্রিয়া। সুতরাং মৌলিক বিচারে এটি একটি রক্ষণাত্মক অবস্থান। একই সাথে এটি এমন একটি অবস্থান যেখানে প্রতিপক্ষ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। যখন কোন ইসলামবিদ্বেষী কোন একটি অভিযোগ আনছে, ধরা যাক সে যিনার শাস্তিকে অমানবিক বলছে – তখন সে বিতর্কের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানস ঠিক করে দিচ্ছে। মানবতা কী? এর মাপকাঠি কী? সে ইতিমধ্যে ঠিক করে দিয়েছে। আমরা বাধ্য হচ্ছি তার ঠিক করে দেয়া মানবতার সংজ্ঞায় শরীয়াহকে মানবিক প্রমাণ করতে। এক্ষেত্রে সমস্যা হল নাস্তিকদের ঠিক করে দেয়া মানদণ্ডে ইসলাম সবসময় প্রমাণিত হবে – এমন কোন কথা নেই। পশ্চিমের আধুনিক বস্তুবাদী, উদারনৈতিক, সেক্যুলার ও ভোগবাদী যে চিন্তা দ্বারা বর্তমানের নাস্তিকরা প্রভাবিত, তার সাথে ইসলামের সংঘর্ষ ব্যাপক। অনেক ক্ষেত্রেই কোনভাবেই ইসলামের অবস্থানকে নাস্তিকদের বেঁধে দেয়া গ্রেডিং সিস্টেমে আমরা পাশ করাতে পারবো না। এটার কোন প্রয়োজনও নেই। সমস্যা ইসলামে না, সমস্যা নাস্তিকদের ঠিক করা মানবরচিত মানবিকতা, আধুনিকতা আর সভ্যতার কাঠামোতে।
.
কিন্তু নাস্তিকতা ও ইসলামবিদ্বেষের সফলতা হল, মুসলিমদের মধ্যে রক্ষণাত্মক মানসিকতা তৈরি করা এবং তাদের সেট করা টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানে ইসলামকে সমর্থন করতে মুসলিমদের বাধ্য করা। একই কথা ইসলামকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল ক্বুরআনের দ্বিতীয় সুরার প্রথমেই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন – এই কিতাবে কোন সন্দেহ নেই ঐ ব্যক্তিদের জন্য যারা গ্বাইবের উপর বিশ্বাস এনেছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞান চিন্তা ক্যাটাগরিকালি গ্বাইবকে অস্বীকার করে। বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সাথে সাংঘর্ষিক কোন প্রমাণিত উপসংহারও তারা মেনে নিতে রাজি না। অন্যদিকে অপ্রমাণিত নানা হাইপোথিসিসকে তারা ধ্রুব সত্য হিসেবে চিত্রিত করে। সুতরাং দুটি দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে বিপরীতধর্মী। এমন অবস্থায় কোন এক আদর্শের লোক যদি বাধ্য হয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় অন্যের আদর্শের আলোকে, তাদের কাঠামোতে নিজের বিশ্বাস ও আদর্শকে সঠিক প্রমাণ করতে চায়, তখন ফলাফল কী হবে?
.
পশ্চিমা কিংবা নাস্তিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন সব ব্যাখ্যা তৈরি করতে হবে। সেটা করতে গিয়ে অবশ্যাম্ভাবীভাবেই ইসলামকে কাটছাঁট করে উপস্থাপন করতে হবে। সালাফ আস-সালেহিনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থান থেকে সরে যেতে হবে। এবং তর্কে জেতার নিয়তে শুরু করলেও একসময় শরীয়াহর ব্যাপারে এই ছাড়গুলো সার্বিকভাবে মুসলিমদের চিন্তাকে প্রভাবিত করবে। ফ্রি-মিক্সিং, বহুবিবাহ, মুরতাদের শাস্তি, জিহাদ শরীয়াহ রাষ্ট্র, সমকামিতার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি, আল ওয়ালা ওয়ালা বারা সহ বিভিন্ন বিষয়ে পশ্চিমে অবস্থিত মুসলিমদের বর্তমান অবস্থার মধ্যে এর বাস্তব উদাহরণ আছে।
.
এ ব্যাপারে উস্তাদ সাইয়্যিদ কুতুবের রাহিমাহুল্লাহ একটি উক্তি প্রাসঙ্গিক -
.
একটি পূর্ণাংগ অথচ খুব সূক্ষ্ম কারিগরি শিল্পযন্ত্রের কোন একটি স্থানে যদি বাইরের কোন একটি পার্ট জুড়ে দেয়া হয় তবে সেই শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের চিন্তা-কর্মের গতিধারা ও নিয়মপদ্ধতি অপরিচিত পথের বিষাক্ত প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তারা মনে করে থাকে যে ইসলামের ভেতর এ সকল বিধান জুড়ে দিয়ে ইসলামের জন্য নবতর শক্তি সঞ্চয় করে দিয়েছেন। এ ধারণা নিতান্ত অমূলক ও বাতিল এবং ইসলামের জন্য খুবই মারাত্মক। এটা ইসলামের প্রান-আত্মা সম্পূর্ণ অকেজো ও অকর্মা করে দেয়, আর এটি একপ্রকার পলায়নী মনোবৃত্তিবিশেষও; যদিও তা পরিস্কারভাবে স্বীকার করা হয় না।
[ ইসলামের সামাজিক সুবিচার ]
.
আরেকটি সমস্যা হল নাস্তিক তথা ইসলামবিদ্বেষীদের মধ্যে অধিকাংশই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য প্রশ্ন করে না। ব্যাপারটা এমন না যে তাদেরকে সঠিক ভাবে উত্তর দিতে পারলে তারা কলেমা পড়ে মুসলিম হয়ে যাবে। বরং এক প্রশ্নের জবাব দিলে তারা আরেক প্রশ্ন করবে, সেটার পর আরেকটা, তারপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকবে। প্রশ্ন হল, মুসলিমরা কি ক্রমাগত এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই থাকবে? যদি তাই হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত এতে মুসলিমদের লাভ কি? তর্কে জেতা? এতো সময়, শ্রম, এবং মনোযোগ ব্যয় করার উদ্দেশ্য হল যাদেরকে আমরা অলরেডি ভুল হিসেবে জানি তাদেরকে ভুল প্রমাণিত করা?
.
কিন্তু এসব কিছু ছাড়াও আরো একটি বড় ঝুঁকি আছে, যেটা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। আর সেটা হল ইসলামকে মানবিক, বৈজ্ঞানিক কিংবা যৌক্তিক প্রমাণ করতে গিয়ে অনেক সময় মুসলিম তার্কিক ও লেখকরা কাফিরদের তৈরি করা চিন্তার কাঠামোকে গ্রহণ করে নেয়। অন্যদিকে ইসলামী আক্বিদা ও ‘ইলমের (ক্বুরআন ও সুন্নাহ) ব্যাপারে সঠিক ধারণা না থাকায় তারা এমন কিছু যুক্তি-তর্ক, প্রমাণ সামনে নিয়ে আসে যা আপাতভাবে উপকারী মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত আক্বিদার ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। জাহমিয়্যাহ, জাবারিয়্যাহ, মু’তাযিলা সহ ইসলামের ইতিহাসে বাতিল ফিরকাগুলোর অনেকগুলোর উৎপত্তিই এভাবে হয়েছে। ইসলামের পক্ষ নিয়ে নাস্তিকদের সাথে তর্কে অবতীর্ণ হওয়া বর্তমান বিশ্বের অনেক নামীদামী বক্তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় এরকম বিচ্যুতি ঘটেছে। সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় হল, যেহেতু মৌলিক আক্বিদা বিষয়ক রচনার বদলে সাধারণ মানুষ এধরনের লেখা বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েন এবং এ লেখাগুলো দ্বারা প্রভাবিত হন, তাই একসময় এ বিচ্যুতিগুলো ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যায়। শরীয়াহর বিভিন্ন বিধানের মতোই আক্বিদার বিভিন্ন বিষয়েও ছাড় দেয়া শুরু হয়, গোমরাহি মেইন্সস্ট্রিম হয়ে যায়। অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে কেবলমাত্র আক্বলের বেইসিসে, অর্থাৎ মানবীয় বুদ্ধির আলোকে দ্বীনের হুকুম-আহকামকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা চালু হয়ে যায়।
.
সর্বোপরি আমার ভাবা প্রয়োজন যে কেবল নাস্তিকতা সংক্রান্ত লেখা মুসলিম সমাজের চিন্তার বিকাশে কতোটুকু সহায়ক হবে। আমাদের সমাজে নাস্তিকতার বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা আছে। একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু একই সাথে তাওহিদের মৌলিক জ্ঞান ও সঠিক আক্বিদা তুলে ধরা, প্রচলিত ভুল ধারণার নিরসন, ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ও মুসলিম হিসেবে পরিচয়ের গুরুত্ব, মুসলিম উম্মাহর পুনঃজাগরনের সঠিক পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা তৈরি, ইসলামের আলোকে সামাজিক সমস্যা ও অবক্ষয়গুলোর সমাধান তুলে ধরা, ফিকহুল ওয়াক্বি বা বাস্তবতা বুঝের বিকাশ করা, পাশ্চাত্যের দর্শন ও বাস্তবতাকে তুলে ধরা ও আক্রমণ করা, ইসলাহ, আত্মশুদ্ধি – ইত্যাদি বিষয় নিয়েও কাজ করা প্রয়োজন। কিন্তু এসব বিষয়ে কি যথেষ্ট কাজ হচ্ছে?
.
সঠিক আক্বিদা ও মানহাজ, সিরাতুল মুস্তাক্বিমের উপর থাকা, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহর অবস্থানের উপর থাকা হল আমাদের মূলধন। আর নাস্তিকদের জবাব দেয়া, তাদের সাথে তর্ক করা, তর্কে জেতা – ইত্যাদি হল মুনাফা বা লাভ। যেকোনো ব্যবসায় লাভ করার চেয়ে মূলধন সংরক্ষণ বেশি গুরুত্ব পায়। একারণে নাস্তিকতা বিষয়ক আলোচনার তুলনামূলক গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। যেহেতু বর্তমানে বাংলায় এ বেশ লেখালেখি হচ্ছে, এবং আলহামদুলিল্লাহ অনেক লেখক এগিয়ে আসছেন তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে সতর্ক হওয়া জরুরী।
---------------
লেখকঃ আসিফ আদনান
Post a Comment