না জেনে ফতোয়া দেয়ার ভয়াবহ পরিণাম


কুরআনের ভাষ্যমতে,

১- না জেনে ফতোয়া দেয়া বা আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে নিজের ধারণা থেকে মতামত দেয়ার প্রবণতা, এটা মূলত শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا يَأْمُرُكُم بِٱلسُّوٓءِ وَٱلْفَحْشَآءِ وَأَن تَقُولُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

নিশ্চয় শয়তান তোমাদেরকে আদেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজের এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলতে, যা তোমরা জান না।
(বাকারা- ১৬৯)

২- আল্লাহ তায়ালা সুরা নাহলের ১১৫ নং আয়াতে "মৃত জন্তু, শূয়োর, রক্ত, ঐসব প্রাণী যা আল্লাহর নামে জবাই করা হয় নাই" ইত্যাদিকে হারাম ঘোষণা করে, পরের আয়াতে বলেন..

وَلَا تَقُولُوا۟ لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ ٱلْكَذِبَ هَٰذَا حَلَٰلٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ

আর তোমাদের জিহবা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।
(সুরা নাহল- ১১৬)

৩- যে বিষয়ে 'ইলম' নেই, সেই বিষয় নিয়ে মতামত দিলে কেয়ামতের দিন জবাবদিহি হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌۚ إِنَّ ٱلسَّمْعَ وَٱلْبَصَرَ وَٱلْفُؤَادَ كُلُّ أُو۟لَٰٓئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـُٔولًا

যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।
(সুরা ইসরা -৩৬)

হাদিসের আলোকে-

১- আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত "যে ব্যক্তি আন্দাজে ফতোয়া দেয়, তাহলে তার ফতোয়ায় আমলকারীর গোণাহ, ফতোয়াদাতার হবে।"

(আবু দাউদ- ৩৬৫৭, মুসনাদে আহমদ ২/৩২১, ইবনু মাজাহ- ৫৩, হাসান)

২- ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার অন্তর থেকে ইল্‌ম বের করে উঠিয়ে নেবেন না; বরং আলিমদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমেই ইল্‌ম উঠিয়ে নেবেন। যখন কোন আলিম বাকী থাকবে না তখন লোকেরা জাহিলদেরই নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, তারা না জেনেই ফতোয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ হবে, আর অপরকেও গোমরাহ করবে।
( বুখারী -১০০ মুসলিম -২৬৭৩)

৩- এক সাহাবী আঘাতপ্রাপ্ত হলেন, সময়টা ছিল শীতকাল। সাহাবীর এহতেলাম (স্বপ্নদোষ) হলো। তিনি লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করণীয়? লোকেরা নিজদের মত ফতোয়া দিল "গোসল করতে হবে"! সাহাবী গোসল করলেন, আর তারপর মারা গেলেন।

এই ঘটনা রাসূল সা. এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন "লোকেরা তাকে হত্যা করল। আল্লাহও তাদের হত্যা করুন"! অপর বর্ণনায়, "হায় হায়! লোকেরা তাকে ভুল ফতোয়া দিয়ে তাকে হত্যা করেছে? আল্লাহও যেন তাদেরকে এর শাস্তি দেন।"

তারপর রাসূল সা. বললেন, লোকটা আঘাতের স্থান মাথা বাদ দিয়ে বাকী দেহ ধুয়ে নিত। আর যেখানে আঘাত, সেটা বাদ দিত, তাহলেই যথেষ্ট হত। অন্য বর্ণনামতে, 'তার উচিত ছিল তায়াম্মুম করা'! তারপর আরো বলেন, অজ্ঞতার চিকিৎসা হচ্ছে জ্ঞানীদের কাছে জেনে নেয়া।
( মুসনাদে আহমদ -৩০৫৬, দারেমী- ৫৭২, আবু দাউদ- ৩৩৬, হাসান)

৪- আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন যে ব্যক্তি না জেনে ফতোয়া দেয়, তার উপর আসমান জমিনের ফেরেশতারা অভিশাপ দেয়।
(মুজামুশ শুয়ুখ- ইবনে আসাকির ১/৩৩০ বা ১/৫৪৭, যায়িফুল জামে -৫৪৫৯ - : فيه أبو القاسم الطائي ضعيف শায়খ আলবানী এটাকে যায়ীফ বলেছেন)

-- না জানা দোষণীয় না, না জানা সত্তেও #জানি বলাটা দোষণীয়..

১- ইমাম শাবী রহ. বলেন, "লা আদরি (আমি জানি না) বলাটাই অর্ধেক ইলম।

২- ইমাম মালেক রহ বলেন 'আলেমের গভীর জ্ঞানের নিদর্শন হচ্ছে 'আমি জানি না' এ কথা বলা।

৩- একবার ইমাম মালেক রহ. কে একটা মাসালা জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন আমি জানি না। প্রশ্নকারী বলল 'আরে এটা তো সাধারণ, সহজ একটা মাসালা"! ইমাম মালেক রাগ হয়ে বললেন "দ্বীনের কোন মাসালাই সামান্য সাধারণ নয়।

৪- ইমাম মালেক রহ এর আরেকটা উক্তি আছে, তিনি বলেন। যে কোন মাসালায় জবাব দিতে যায়, তার উচিত জবাব দেয়ার পূর্বে নিজেকে জান্নাত জাহান্নামের সামনে পেশ করা। (অর্থাৎ, না জেনে ভুল ফতোয়া দিলে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হতে পারে)

৫- ইমাম আহমদ রহ, সবচেয়ে বেশি বলতেন 'লা আদরি' (আমার জানা নেই)

৬- বিশিষ্ট তাবেয়ী আব্দুর রহমান বিল লাইলাহ রহ. বলেন, আমি ১২০ জন আনসারী সাহাবী পেয়েছি, তাদেরকে যখন কোন মাসালা জিজ্ঞেস করা হত, তারা নিজে উৎসাহী হতেন না। বরং একজন আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।

(জামিয়ু বয়ানিল ইলমি ও ফাদলিহি- ইবনে আব্দিল বার, ইলামুল মুয়াক্কীনীন- ইবনুল কায়্যিম)

এ ছিল সাহাবা, তাবেয়ী ও সালাফের আমল। আর আমাদের প্রবণতা? একটু নিজেকে তাদের আমলের সামনে পেশ করি। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক দিন।

* সবশেষে রাসূল সা. এর একটা বর্ণনা উল্লেখ করছি।
ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল সা. জিজ্ঞেস করল "কোন স্থান সর্বোত্তম? রাসূল সা. বললেন "আমার জানা নেই"। আমি জিবরীল কে জিজ্ঞেস করে দেখি। তিনি জিবরীল কে জিজ্ঞেস করলে, জীবরীল বললেন "আমারও জানা নেই"। আমি মীকাইলকে প্রশ্ন করব। (অন্য রেওয়ায়েতে আছে, 'আমি আমার রবকে প্রশ্ন করে জেনে নিব') অত:পর তিনি জেনে এসে রাসূল সা. কে জানালেন। রাসূল সা. বললেন "সর্বোত্তম স্থান মসজিদসমূহ, আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থানগুলো হচ্ছে বাজার/মার্কেটগুলো।" (সহীহ ইবনে হিব্বান- ১৫৯৯, মুসনাদ আবি ইয়ালা- ৭৪০৩, হাকেম- ৩০৩ হাসান)

Post a Comment

Previous Post Next Post