মুসলিম ইতিহাসবেত্তাদের ব্যাপারে ওরিয়েন্টালিস্টদের মিথ্যা সমালোচনা



মুসলিম ইতিহাসবেত্তাদের ব্যাপারে ওরিয়েন্টালিস্টরা বেশ সমালোচনা করেন। একটি মেইন সমালোচনা হচ্ছে, তারা মুসলিমদের বেশি প্রশংসা করেছেন এবং অবিশ্বাস্য সব ঘটনার উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, অমুসলিমদের সমালোচনায় কঠোরতা অবলম্বন করেছেন।


ওরিয়েন্টালিস্টরা কোন বইগুলো পড়ে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে সাহাবিদের বাদ দিলে (কারণ, তাদের সমালোচনা করতে রাসুলুল্লাহ নিষেধ করে গেছেন) সবার ব্যাপারেই মুসলিম স্কলাররা লিখেছেন। যেখানে তারা প্রশংসার দাবিদার, সেখানে তাদের প্রশংসা করেছেন। আবার যেখানে সমালোচনার কাজ করেছেন, সেখানে কঠিন সমালোচনাও হয়েছে।


এটা নিয়ে আলাদা একটা সাইন্সই আছে, 'জরাহ ওয়া তা'দিল'। যারা হাদিস নিয়ে পড়াশুনা করেন, তারা সবাই এ ব্যাপারে জানেন। হাদিসশাস্ত্রে অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে। আমাদের আলেমরা আমানতদারিতার চূড়ান্ত নির্দশন দেখিয়েছেন এখানে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইলমের প্রতি ইনসাফ করতে গিয়ে তার পিতাকে 'দুর্বল' বলেছেন, আবার নিজের শত্রুকেও হাদিসের 'বিশ্বস্ত' বর্ণনাকারী বলেছেন।


এটা তো গেলো হাদিসশাস্ত্র। এখানে বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই। কিন্তু ইতিহাসশাস্ত্রে কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি করা যায় চাইলেই। নিজের আবেগ ঢেলে কাউকে হিরো বানিয়ে ফেলা যায়, আবার কাউকে বানিয়ে ফেলা যায় ভিলেন। নিজের বাবা-মা, পরিবার, বংশ নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখেছেন বহু ইতিহাসবিদই। এ মানবীয় ত্রুটি মুসলিম-অমুসলিম সব ধরনের ইতিহাসবিদদের মাঝেই কম-বেশি দেখা যায়।


অত্যাচারী শাসকরা ইতিহাসবেত্তাদের এই গুণটা খুব কাজে লাগাতেন। জনগণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে নিজেদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে রূপকথার কাছাকাছি কিছু একটা তারা লিখিয়ে নিতেন। বিনিময়ে বিশাল পুরষ্কার দিতেন।


বলা যায়, অত্যাচারী শাসকদের এই গুণটা এখনো হারিয়ে যায় নি। তারা এখনো ভাড়াটে সাহিত্যিকদের মাধ্যমে নিজের পিতা কিংবা পিতামহদের খোদার কাছাকাছি বসাবার চেষ্টা করে। যেন মানুষ তাদের ব্যাপারে টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে না পারে। আর তাদের ব্যাপারে কথা বলতে না পারলে তার ব্যাপারেও কেউ কথা বলতে পারবে না। ক্ষমতা একেবারে পাকাপোক্ত। মানুষ বুঝে যাবে, তার কোনো বিকল্প নেই।


অবশ্য উনাদের খুব একটা দোষ দিয়ে লাভও নেই। বললাম না, অনেক ইতিহাসবেত্তাদের এই রোগ ছিলো— নিজের বংশের লোকদের মহৎ করে দেখানোর প্রবণতা।


তবে মুসলিমদের একটা প্রাপ্তি হলো, যারা ক্লাসিকাল মুসলিম ইতিহাসবেত্তা ছিলেন, যেমন ইমাম তাবারি (রহ), ইমাম যাহাবি (রহ), ইমাম ইবনে কাসির (রহ)— তারা সবাই এই ছোটলোকি থেকে মুক্ত ছিলেন।


রিসেন্টলি ইবনে কাসিরের বিখ্যাত বই 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া'— এর পাতা উল্টোচ্ছিলাম। ১৪তম খণ্ড, ৭০৩ হিজরিতে (১৩০৩ খ্রি.) এসে উনি তার পিতার কথা উল্লেখ করেছেন।


উনার পিতার নাম শিহাবুদ্দীন আবু হাফস উমর ইবনে কাসির। নিজের বংশ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ইবনে কাসির (রহ) কেবল লিখেছেন, তার পিতা অভিজাত বংশে জন্মেছিলেন। কেমন অভিজাত তা নিয়ে একটা লাইনও লিখেন নি। তার বাসায় এসে কোনো খলিফা কিংবা কোনো মন্ত্রী চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি খেয়েছিলো কিনা, তা আমরা তাই জানতে পারি নি। তার বংশে কেউ খলিফার রাজদরবারে ছিলো কিনা কিংবা সরকারি আমলা ছিলো কিনা, তাও তাই জানার উপায় নেই।


পিতার জন্মস্থান নিয়ে সামান্য লিখেই তিনি চলে গেলেন পিতার ইলমি সফরের বর্ণনায়। উনার পিতা প্রথমে হানাফি মাজহাবের কিছু কিতাব পড়েন। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী হয়ে যান।


কবিতায় তার বেশ ভালো দখল ছিলো। ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। ইবনে কাসির তার 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া' গ্রন্থে শতশত কবির কবিতা উদ্ধৃত করেছেন। অথচ নিজের পিতার একটা কবিতাও উদ্ধৃত করেন নি।


উনার পিতা একটি মসজিদের খতিব ছিলেন। খুব সুন্দর বয়ান করতেন। বয়ান করার সময় খুব হৃদয়নাড়ানো কথা বলতেন। তার বাণী মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। অথচ ইবনে কাসির (রহ) পিতার একটি বাণীকেও উদ্ধৃত করার প্রয়োজন মনে করেন নি।


পিতা সম্পর্কে সামান্য লিখেই তিনি চলে যান তার পরিবারের বর্ণনায়। তার লেখা পড়ে বোঝা যায়, তার বাবার দুইজন স্ত্রী ছিলো। প্রথম ঘরের সন্তানেরা হলো ইসমাইল, ইউনুস, ইদরিস। আরেকঘরে ছিলো আবদুল ওয়াহাব, আবদুল আযিয, মুহাম্মাদ, কয়েকজন বোন, আর ইবনে কাসির নিজে। তার পিতা অবশ্য উনার নাম দিয়েছিলেন ইসমাইল।


নামের লিস্টটা ভালো করে পড়লে দেখা যাবে 'ইসমাইল' হচ্ছে তার পিতার প্রথম সন্তানের নাম, যে কিনা একেবারে প্রথম ঘরে জন্মেছিলো। আবার শেষ সন্তান ইবনে কাসিরেরও ডাকনাম ইসমাইল।


এর কারণ ইবনে কাসির লিখেছেন। তার বাবা নিজের প্রথম সন্তান ইসনাইলকে নিজে কুরআনের হাফেজ বানিয়েছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে ইসমাইল আরবি ভাষা, উসুলুল ফিকহে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কিন্তু একদিন তার এই ভাইটি ছাদ থেকে পড়ে যেয়ে মারা যান। আর এ ঘটনায় ইবনে কাসিরের বাবা প্রচণ্ড আঘাত পান। তিনি বড়ো ছেলের নাম বেশকিছু শোক কবিতা আবৃত্তি করেন।


বড়ো ছেলে মারা যাবার পর ইবনে কাসির (রহ) যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন পিতা তার নামও রাখেন ইসমাইল। হয়তো তার বাবার স্বপ্ন ছিলো, বড়োছেলের মতো ইবনে কাসিরকেও তিনি নিজে দ্বীনি 'ইলম শেখাবেন।


কিন্তু ইবনে কাসিরের বয়স যখন মাত্র তিন, তখন তার বাবা মারা যান। ইবনে কাসির নিজের বাবার মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, বাবার মৃত্যুটা আমি এখনো একটা স্বপ্নের মতো অনুভব করতে পারি।


মজার ব্যাপার, ইবনে কাসির তার মায়ের পেটের ভাইবোনদের নিয়ে একটা লাইনও সেখানে লেখেন নি, লিখেছেন সৎভাই ইসমাইলকে নিয়ে। যার নাম তার পিতা তাকে দিয়েছিলেন।


আর কারো জন্যে দু'আ না করলেও তিনি তার সৎভাই ইসমাইলের জন্যে এখানে ঠিকই দু'আ করে বলেছেন, 'আল্লাহ সেই লোকটির ওপর রহম করুন, যিনি গত হয়েছেন আর বর্তমানদের জন্যে কল্যাণ রেখে গেছেন।' আর এই লাইনের মাধ্যমে কোটি কোটি ইতিহাসপ্রেমি মুসলিম যখনই এই বই পড়বে, তার সৎ ভাইয়ের জন্যে দু'আ করতে থাকবে।


ইবনে কাসিরের 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া' ঠিক কতোখানি বৃহৎ আমার জানা নেই। ছয়-সাত হাজার পৃষ্ঠা তো হবেই বাংলায় অনুবাদ করলে। অথচ নিজের পরিবারকে নিয়ে তিনি দেড়পৃষ্ঠাও লিখেন নি। আবার আলেমও নন এমন ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেছেন।


চিন্তা করলে অদ্ভুত লাগে! আবার অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে ঠিকই লাগে। তাদের কাছ থেকে এমনটাই তো প্রত্যাশিত।

Post a Comment

Previous Post Next Post