বিদায় হজ্জের ভাষণ

আরাফাতে অবস্থান ও ১ম ভাষণ :
৯ যিলহাজ্জ শুক্রবার সকালে তিনি মিনা হ’তে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ওয়াদিয়ে নামেরাহ’তে (وادي نمرة) অবতরণ করেন। যার একপাশে আরাফাত ও অন্যপাশে মুযদালিফাহ অবস্থিত। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে তিনি ক্বাছওয়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আরাফাত ময়দানের বাতনে ওয়াদীতে (بطن الوادي) আগমন করলেন। এটি ছিল একটি পাহাড়ী টিলা। যা জাবালে রহমত (جبل الرحمة) বলে খ্যাত। তার উপরে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় তিনি সম্মুখে উপস্থিত ১ লক্ষ ২৪ হাযার অথবা ১ লাখ ৪৪ হাযার ভক্ত মুসলমানের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। আরাফাতের ময়দানের উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন,

(১) ‘হে জনগণ! তোমরা আমার কথা শোন! কারণ আমি জানি না এরপর আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হ’তে পারব কি-না’।[5]

(২) ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও মাল-সম্পদ, তোমাদের পরস্পরের উপরে এমনভাবে হারাম, যেমনভাবে তোমাদের আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)।

(৩) ‘শুনে রাখ, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল। জাহেলী যুগের সকল রক্তের দাবী পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের রক্ত সমূহের প্রথম যে রক্তের দাবী আমি পরিত্যাগ করছি, সেটি হ’ল রাবী‘আহ ইবনুল হারেছ-এর শিশু পুত্রের রক্ত; যে তখন বনু সা‘দ গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোযায়েল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল’।

(৪) ‘জাহেলী যুগের সূদ পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের সূদ সমূহের প্রথম যে সূদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটা হ’ল আববাস ইবনু আবদিল মুত্ত্বালিবের পাওনা সূদ। সূদের সকল প্রকার কারবার সম্পূর্ণরূপে শেষ করে দেওয়া হ’ল’।

(৫) ‘তোমরা মহিলাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহ্র আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহ্র কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের প্রাপ্য হক হ’ল এই যে, তারা তোমাদের বিছানা এমন কাউকে মাড়াতে দেবে না, যাদেরকে তোমরা অপসন্দ কর। যদি তারা সেটা করে, তবে তোমরা তাদের প্রহার করবে যা গুরুতর হবে না। আর তোমাদের উপরে তাদের প্রাপ্য হক হ’ল সুন্দর রূপে খাদ্য ও পরিধেয়।

(৬) ‘আর জেনে রাখ, আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি এমন এক বস্ত্ত, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আর সেটি হ’ল আল্লাহ্র কেতাব’।[6]

(৭) ‘হে জনগণ! শুনে রাখ আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে কোন উম্মাত নেই। অতএব তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর, রামাযান মাসের ছিয়াম রাখো, সন্তুষ্ট চিত্তে তোমাদের মালের যাকাত দাও, তোমাদের প্রভুর গৃহে হজ্জ কর, তোমাদের শাসকদের আনুগত্য কর, তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর’।[7]

(৮) আর তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তখন তোমরা কি বলবে? লোকেরা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি সবকিছু পৌছে দিয়েছেন, দাওয়াতের হক আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন’। অতঃপর তিনি শাহাদাত অঙ্গুলি আসমানের দিকে উঁচু করে ও সমবেত জনমন্ডলীর দিকে নীচু করে তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’।[8]

উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত ভাষণ উচ্চ কণ্ঠে জনগণকে শুনাচ্ছিলেন রাবী‘আহ বিন উমাইয়া বিন খালফ। আল্লাহ্র কি অপূর্ব মহিমা![9] মক্কায় হযরত বেলালের উপরে লোমহর্ষক নির্যাতনকারী, রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ নেতার অন্যতম নিকৃষ্টতম নেতা ও বদর যুদ্ধে নিহত উমাইয়ার ছেলে আজ রাসূল (ছাঃ)-এর দেহরক্ষী ছাহাবী।

মিনায় ২য় ভাষণ :

সুনানে আবুদাঊদের বর্ণনা অনুযায়ী ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন সকালে সূর্য উপরে উঠলে[14] (حين ارتفع الضحى) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি সাদা-কালো মিশ্রিত খচ্চরে (بغلة شهباء) সওয়ার হয়ে (কংকর নিক্ষেপের পর) জামরায়ে আক্বাবায় এক ভাষণ দেন। এমতাবস্থায় লোকদের কেউ দাঁড়িয়েছিল কেউ বসেছিল। হযরত আলী (রাঃ) তাঁর ভাষণ লোকদের শুনাচ্ছিলেন। এ দিনের ভাষণে তিনি আগের দিন আরাফাতের ময়দানে দেওয়া ভাষণের কিছু কিছু পুনরুল্লেখ করেন।[15] ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু বাকরাহ (রাঃ) প্রমুখাত বর্ণিত হয়েছে যে, এদিনে তিনি বলেন,

(১) হে জনগণ! তোমরা আমার নিকটে থেকে হজ্জ ও কুরবানীর নিয়ম-কানূন শিখে নাও। সম্ভবতঃ আমি এ বছরের পর আর হজ্জ করতে পারব না’।[16]
তিনি আরও বলেন,

(২) ‘কালচক্র আপন রূপে আবর্তিত হয়, যেদিন থেকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি হয়েছে। বছর বারো মাসে হয়। তারমধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। তিনটি পরপর, যুলক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম এবং রজবে মুযার’[17] হ’ল জুমাদা ও শা‘বানের মধ্যবর্তী।[18]

(৩)তিনি বললেন, জেনে রেখ, তোমাদের রক্ত, তোমাদের মাল-সম্পদ, তোমাদের ইয্যত তোমাদের উপরে এমনভাবে হারাম যেমনভাবে তোমাদের আজকের এই দিন, এই শহর, এই মাস তোমাদের জন্য হারাম (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)।

(৪) ‘সত্বর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! আমার পরে তোমরা পুনরায় ভ্রষ্টতার দিকে ফিরে যেয়ো না এবং একে অপরের গর্দান মেরো না’।

(৫) ‘ওহে জনগণ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? লোকেরা বলল, হাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণকে কথাগুলি পৌঁছে দেয়। কেননা উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চাইতে অনুপস্থিত যাদের কাছে এগুলি পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অনেকে অধিক বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে’।[19] অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, উক্ত ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেছিলেন,

(৬) ‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের উপরে বর্তাবে না। মনে রেখ, পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের উপরে এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার উপরে বর্তাবে না’।

(৭) মনে রেখ, শয়তান তোমাদের এই শহরে পূজা পাওয়া থেকে চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে যেসব কাজগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে কর, সেসব কাজে তার আনুগত্য করা হবে, আর তাতেই সে খুশী থাকবে’।[20]

এদিন তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا مَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা শক্তভাবে ধারণ করে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহ্র কিতাব, অপরটি তাঁর নবীর সুন্নাত’।[21]

মিনায় ৩য় ভাষণ :

আইয়ামে তাশরীক্বের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১২ই যিলহাজ্জ তিনি আরেকটি ভাষণ দেন।[22]
এদিন তাঁর ভাষণ কুরবানীর দিনের ভাষণের অনুরূপ ছিল এবং এই ভাষণটি সূরা নছর নাযিলের পরে দেওয়া হয়েছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, সূরা নছর নাযিল হয়েছিল বিদায় হজ্জে মিনায় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে। এরপর নাযিল হয় ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার বিখ্যাত আয়াতটি- সূরা মায়েদাহ ৩ আয়াত। এ দু’টি আয়াত নাযিলের পর তিনি ৮০ দিন বেঁচে ছিলেন। অতঃপর মৃত্যুর ৫০দিন পূর্বে নাযিল হয় আয়াতে ‘কালালাহ’ (নিসা ১৭৬)।

অতঃপর ৩৫ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা তওবাহর সর্বশেষ দু’টি আয়াত (তওবা ১২৮, ১২৯)। অতঃপর ২১ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা বাক্বারাহ্র ২৮১ আয়াতটি।[23] এতে বুঝা যায় যে, সূরা নছর কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে বিদায় হজ্জের সময় নাযিল হয়েছে। এরপরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আয়াত নাযিল হ’লেও কোন পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়নি।

খুম কূয়ার নিকটে ভাষণ (خطبة غدير خم) :

হজ্জ থেকে ফেরার পথে বুরাইদা আসলামী (রাঃ) রাসূলে করীম (ছাঃ)-এর নিকটে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে কিছু অভিযোগ পেশ করেন। যা ইয়ামনে গণীমত বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ে ছিল। মূলতঃ এটা ছিল বুরাইদার বুঝের ভুল। এজন্য আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) খুম কূয়ার নিকটে যাত্রাবিরতি করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যাতে তিনি নবী পরিবারের উচ্চ মর্যাদা ব্যাখ্যা করেন। অতঃপর হযরত আলীর হাত ধরে বলেন, مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ ‘আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু’।[24]

এই ভাষণ শ্রবণের পরে হযরত ওমর (রাঃ) আলী (রাঃ)-কে অভিনন্দন জানান এবং হযরত বুরাইদা (রাঃ) তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হন। তিনি সারা জীবন হযরত আলীর প্রতি মহববত ও আনুগত্য বজায় রাখেন। অবশেষে তিনি ‘উটের যুদ্ধে’ (ﺟﻨﮓ جمل) শহীদ হন।

---------------------------
[5]. দারেমি হা/ ২২৭; ফিকহুস সিরাহ ৪৫৬ পৃঃ
[6]. মুসলিম হা/ ১২১৮; মিশকাত হা/ ২৫৫৫
[7]. ত্বাবারানী, আহমদ, মিশকাত হা/ ৫৭১; সিলসিলা ছহীহা হা/ ৩২৩৩
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/ ২৫৫৫
[9]. স্বীরাত ইবনে হিশাম ২/ ৬০৫
[10]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৬০; আল-বিদায়াহ ৫/২১৫।
[11]. তওরাত ও ইনজীলের প্রমাণাদি সহ বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য রাহমাতুল্লিল আলামীন ১/২৩৫-৩৬ টীকা-২।
[12]. তিরমিযী হা/৩০৪৪, সনদ ছহীহ।
[13]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫।
[14]. সম্ভবতঃ কুরবানীর পূর্বেই এ ভাষণ দেন।
[15]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৬৭১।
[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৬১৮।
[17]. মুযার গোত্রের দিকে সম্পর্কিত করে ‘রজবে মুযার’ বলা হয়েছে।
[18]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৫৯।
[19]. বুখারী হা/১৭৪১ ‘মিনায় ভাষণ’ অনুচ্ছেদ; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৫৯।
[20]. তিরমিযী হা/২১৫৯; ইবনু মাজাহ হা/২৭৭১ ‘হজ্জ’ অধ্যায়; মিশকাত হ/২৬৭০।
[21]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/১৮৬।
[22]. আবুদাঊদ হা/১৯৫২ ‘মানাসিক’ অধ্যায় ৭১ অনুচ্ছেদ; আওনুল মা‘বূদ হা/১৯৩৬-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[23]. কুরতুবী সূরা নছর-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[24]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৬০৮২, ছহীহাহ হা/১৭৫০।

Post a Comment

Previous Post Next Post