আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পেয়েছি
সকাল ৮:৪০, অথচ এখনো আমি দাত ব্রাশ করছি। ৯ টায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে, তাই তাড়াহুড়ো করে নাস্তা না করেই বাসা থেকে বের হয়ে পড়েছি যেকোন ভাবেই ক্লাস ধরতে হবে । একটা ক্লাস মিস হয়ে গেলেই যে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে!
দুপুর ২:৩০, ক্লাস থেকে এসে কোনরকম দুপুরের খাবার শেষ করলাম মাত্র। এখনি বের হতে হবে। বিকেল ৩ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত ২ টা প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তে হবে।
সন্ধ্যে ৬ টা, প্রাইভেট টিচারের কাছ থেকে এসেছি মাত্র। এখনি ফ্রেশ হয়ে পড়া শুরু করতে হবে। অনেক পড়া। পড়তে পড়তে ১২ টার দিকে ঘুমিয়ে যাওয়া।
খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে দিনগুলো। সামনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। ভাল করে শ্বাস নেওয়ার সময়ও নেই।পড়তে পড়তে কখন যে চোখ বুজে আসে! আবারো সেই একই ব্যস্ততা ....।
বাড়িতে যাইনা অনেকদিন।ছোট বোনটাকেও দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়, এত কষ্ট এত পরিশ্রম আর ভাল লাগেনা। তবুও থাকতে হয়, তবুও পড়ি কারণ বাবার কথাগুলো বার বার কানে ভাসে। গ্রাম থেকে আসার সময় বাবা বলেছিল তুমি এখন ইন্টারমিডিয়েট এ পড়ছ। তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হচ্চে এই উচ্চ মাধ্যমিক। কারণ এটা তোমার জীবনকে বদলে দেবে, তোমার ক্যারিয়ারের পথ তোমাকে দেখিয়ে দিবে, এই সময়টা যত বেশি পরিশ্রম করবে, যত বেশি পড়াশুনায় কাটাবে ততই তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
বাবা-মা'র স্বপ্ন আমি এস.এস.সি'র মত এইচ.এস.সি তেও ভাল ফলাফল করে মেডিকেলে চান্স পাব। বড় ডাক্তার হব।অনেক টাকা থাকবে, দামি ফ্ল্যাট থাকবে, থাকবে দামি গাড়িও, সমাজের নেতৃত্ব থাকবে আমাদের হাতে।
সত্যি! আমিও চাই।আমিও চাই একদিন আমি অনেক বড় হব। আমার গাড়ি-বাড়ি থাকবে। থাকবে অর্থের ভুড়ি। সমাজ আমাকে বাহবা দিবে। জীবনটাকে নিজের মত করে উপভোগ করার থাকবে সব উপাদান। চিন্তা করতে করতে আমার চোখ ছলছল করে উঠে। বাবার সেই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে হবে। ভাবতে ভাবতে আবারো আশা ফিরে পাই।আবারও উদ্যমী হই। সময়গুলো যে নষ্ট করা যাবেনা! আমাকে পড়তে হবে, আরও অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হবে!
সত্যি আমরা সবাই ব্যস্ত। আমরা সবাই খুব পরিশ্রম করছি। রঙ্গিন স্বপ্নগুলো না দেখে আমাদের ঘুম আসেনা। সেই স্বপ্নগুলোর পেছনে ছুটতে গিয়েই আমরা খুব বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের স্বপ্নগুলোর পেছনে ছুটছি কারণ আমাদের উদ্যেশ্য হল ভবিষ্যত জীবনে একটু ভাল থাকার, জীবনটাকে একটু উপভোগ করার।
তবে শত বছর আগেও আমরা এই পৃথিবীতে ছিলাম না, আর শত বছর পরেও হয়ত আমরা এই পৃথিবীতে থাকবনা! তাহলে মধ্যের এই সময়টাতে যে, কিছু সময়ের জন্য আমাদের এই পৃথিবীতে আগমন তা কিসের জন্য? কী উদ্দেশ্যেই বা আমরা এই সামান্য সময়ের জন্য পৃথিবীতে অবস্থান করব?
আমরা যেমন আমাদের নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাদের রঙিন স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছি, ঠিক তেমনি বড় একটি উদ্যেশ্য সাধনের জন্য আমাদেরকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আর সেই উদ্যেশ্য হল আমার প্রভুর আনুগত্য করা। তাই আমাদের প্রভু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা ই আমাদেরকে বলে দিয়েছেন কি উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে তিনি আমাদের আগমন ঘটিয়েছেন-
তিনি বলেন, "আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।" -(সূরা যারিয়াত:৫৬)
আর তা পরীক্ষা করার জন্য "যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।" -(সূরা মূলক:২)
দুনিয়ার সেই রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে চলছিল দিনগুলো...
তখন নতুন ফেইসবুক একাউন্ট খুলেছি মাত্র। অবসর সময়গুলোতে লাইক দেওয়া বিভিন্ন পেইজগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ ইসলামিক পেইজের একটা লেখায় এসে চোখ আটকে গেল। আমি জানিনা লেখাটি কোন দ্বীনি ভাই লিখেছিল! তবে এই লেখাটি আমার ভিতরকে নাড়া দিয়েছিল, আমার জীবনের উদ্যেশ্যকে বদলে দিয়েছিল, স্বপ্নগুলোকে নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছিল, পৃথিবীতে আমার আগমনের উদ্দেশ্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, যোগিয়েছিল ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানার জন্য নতুন উদ্দীপনা।
এভাবে ইসলামকে জানতে ও বুঝতে শুরু করা, জীবনের উদ্যেশ্যকে পারিবর্তন করে নেয়া, ইসলাম নিয়ে পড়া শুরু করা, দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে জানার এবং বাস্তব জীবনে রূপান্তরিত করার স্পৃহা জেগে উঠা। আলহামদুলিল্লাহ।
আর ইসলাম মানে হল আনুগত্য। তাই জীবনের প্রতিটি স্তরে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি। ইসলামকে জানার পর ইসলামকে ভালবাসতে পারেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারণ ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরকে কিভাবে পরিচালনা করতে হবে সে পথ দেখিয়ে দেয়।ইসলামের প্রতিটি বিধান পালনের মধ্যেই রয়েছে প্রশান্তি। ইসলামই পারে একটি মানুষকে আলোর পথ দেখাতে এবং ইসলামই দেখিয়ে দেয় দুনিয়া এবং আখিরাতের জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সহজ উপায়।
ইসলাম নিয়ে যতই চিন্তা করি ততই আমি মুগ্ধ হই । সত্যি মানুষের জীবনকে খুব বেশী পরিবর্তন করার জন্য যা প্রয়োজন তা হল ইসলাম। ইসলামই মানুষকে খুব দ্রুত পরিবর্তন করে দিতে পারে। ইসলামের ছায়াতলে এসে শত শত মানুষ পরিবর্তন হয়েছে। যেমনটি আমার অনেক বন্ধু হয়েছে, আমিও হওয়ার চেষ্টা করছি। আর এ পরিবর্তন হবে এটাই অবধারিত সত্য।
একটা সময় আমি খুব ভাল গান করতাম, খুব বেশী গান শুনতাম। গান ছাড়া জীবনটাকেই অর্থহীন মনে করতাম । মাথায় সবসময় চিন্তা থাকত কখন কোন গান রিলিজ হচ্ছে। কোন মুভিটা রিলিজ হওয়ার পর সাথে সাথে ডাউনলোড করব! জীবনটাকে কিভাবে উপভোগ করা যায় সেটাই ছিল আড্ডার মূল বিষয়।
সত্যি এখন আর গান ভাল লাগেনা। সেই মিউজিক গুলোই এখন খুব বেশী বিরক্তিকর মনে হয়। তাই গানগুলো আর শুনা হয়না। গাইতেও ইচ্ছে হয়না। নতুন কি মুভি রিলিজ হয়েছে সেই খবরও আর নেওয়া হয়না। জীবনকে কত বেশী রোমাঞ্চিত করা যায় সেই প্ল্যানিং নিয়েও আড্ডা গরম হয়না। ইসলামে আসার প্রথম পর্যায়ে যখন কোরআনের অনুবাদ কিনে পড়তে শুরু করলাম, তখন কোরআনের এত সুমধুর আয়াতগুলো হৃদয়ে অন্য এক অনুভূতি সৃষ্টি করল।প্রত্যেকটি আয়াত তিলাওয়াত করার পর যখন অনুবাদগুলো পড়তাম তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারতামনা। চোখ দিয়ে এত বেশী অশ্রু বের হত যে, কোরআনের পৃষ্ঠাগুলোই ভিজে যেতো, তখন থেকেই আশা করছি ইসলামের প্রতি ভালবাসা, কোরআনের প্রতি ভালবাসা, আল্লাহ ও রাসুলের (সাঃ) প্রতি আনুগত্য আমাকে আমার গন্তব্যে নিয়ে যাবে। ইন শা আল্লাহ্ ।
ইসলামকে বুঝতে শুরু করার সময় থেকেই কেমন জানি হয়ে গেলাম আমি। শুরুতে নিজেকে নিজেই চিনতে পারছিলাম না। খুব একা মনে হচ্ছিল তখন নিজেকে। দুনিয়ার এই চমকপ্রদ জীবনের কোন অর্থই খুজে পাচ্ছিলাম না।পৃথিবীর সামান্য জীবনটাকে খুব বেশী অর্থহীন মনে হতে শুরু হলো। জীবনের উদ্দেশ্যটাকে ভিন্ন রূপ দিতে শুরু করলাম। নতুন এক স্বপ্ন, নতুন এক আশা আমাকে হাতছানি দিতে শুরু করল।
আসলে ইসলামের প্রতি ভালবাসাই মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি বদলে দিতে পারে। এই ভালবাসা এমন এক ভালবাসা, এই বদলে যাওয়া এমন এক বদলে যাওয়া, যার স্পর্শে যেই ছেলেটি গান ছাড়া জীবনের অর্থকেই খুঁজে পেতোনা, সেই ছেলেটি এখন আর গান সহ্যই করতে পারেনা, গিটারকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোরআনকে হাতে তুলে নেয়। কোরআনের অক্ষরগুলোতেই প্রশান্তি খুজে পায়। মুভি ছাড়া যার চলতইনা, সেই এখন মুভিগুলো ডিলিট করে দিয়ে ইসলামিক ভিডিও লেকচারগুলোকে সেখানে প্রতিস্থাপন করে নেয়। প্যান্টকে পায়ের নিচে ঝুলিয়ে না পড়লে যার স্মার্টনেস থাকতোনা, সেই এখন টাকনূর নিচে প্যান্ট পড়তে ঘৃণাবোধ করে। গালফ্রেন্ডের সাথে ঘন্টা দুয়েক কথা না বললে রাতটাই যার বৃথা যেত, সে এখন রাতের অন্ধকারে সালাতে দাড়িয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলেই প্রশান্তি পেতে চায়।
যে ইসলাম এভাবেই মানুষকে বদলে দিয়ে নতুন একটি আলোর পথ দেখাতে পারে, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে দিতে পারে, সে ইসলামকে ভালো না বেসে কি করে থাকি ?
আর পৃথিবীতে যত অন্যায় হয় তার বেশীরভাগই হয় ভুল জিনিসকে ভালবেসে। তাই প্রত্যেকই ইসলামকে ভালোবাসা মতো মহৎ ও সঠিক অনুভূতিটিকে সবসময়ের জন্য অন্তরে লালন করা উচিত । আর তখন তাঁর অন্তরই তাঁকে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে দিবে ।
সবশেষে আমার প্রভুর পক্ষ হতে দুটি ঘোষণা:
"যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উম্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌছাবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক, অতঃপর সদাসর্বদা বসবাসের জন্যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর।" -(সূরা যূমার:৭৩)
"তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান চিরকাল বসবাসের জান্নাত, যার তলদেশে নির্ঝরিণী প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্যে, যে তার পালনকর্তাকে ভয় কর।" -(সূরা বাইয়্যিনা:৮)
লিখেছেন: মোহাম্মদ শাহজাহান (IIUC)
মাশাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।
উত্তর দিনমুছুন