● ইসরা ও মিরাজের তারিখ:
ইমাম কুরতুবী (রহ.) স্বীয় তাফসির গ্রন্থে বলেন, মিরাজের তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে। মুসা ইবনে ওকবার রেওয়ায়েত এই যে ঘটনাটি হিজরতের ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত খাদিজার ওফাত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে হয়েছিল। ইমাম যুহরী (রহ.) বলেন, হজরত খাদিজার ওফাত নবুওয়াতপ্রাপ্তির সাত বছর পরে হয়েছিল। মুহাদ্দেসগণ বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করার পর কোনো সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেননি। (মা'আরিফুল কোরান)
এ থেকে বোঝা যায়, শবে মিরাজ, শবেকদরের মতো বিশেষ রাত নয়। মিরাজ রজনী শবেকদরের মতো হলে এর মাস তারিখ সংরক্ষণেও গুরুত্ব দেওয়া হতো। যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শবেকদরের। যেহেতু এ রাতের তারিখ সংরক্ষিত নেই, তাই ২৭ তারিখকে শবেমিরাজ নির্ধারণ করাও কঠিন।
● ওই রাতই ফজিলতপূর্ণ ছিল:
মেনেও যদি নিই ২৭ রজবে মিরাজ সংঘটিত হয়েছে, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.)-কে বিশেষ নৈকট্য দান করেন। মুসলমানদের নামাজ উপহার দেন। তাহলে নিঃসন্দেহে ওই রাতই ছিল ফজিলতপূর্ণ। এই রাতের ফজিলত নিয়ে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে এই ফজিলত প্রতি বছরের ২৭ রজবের নয়।
● রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় ১৮ বার শবেমিরাজ এসেছিল:
দ্বিতীয় কথা হলো, নির্ভরযোগ্য মতানুসারে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়াতের পঞ্চম বছর। এ ঘটনার পর নবী করিম (সা.) আরো ১৮ বছর সাহাবাদের মাঝে ছিলেন। কিন্তু শবেমিরাজের ব্যাপারে এ দীর্ঘ সময়ে কোথাও কোনো বিশেষ হুকুম দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা উদ্যাপনেও গুরুত্বারোপ করেননি। রাসুল (সা.) নিজেও এ রাতে জেগে থাকেননি। সাহাবিদেরও জাগতে বলেননি। রাসুল (সা.) পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ১০০ বছর সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। শতাব্দীজুড়ে এমন একটি ঘটনাও পাওয়া যায় না, যেখানে সাহাবায়ে কেরাম ২৭ রজবকে বিশেষভাবে উদ্যাপন করেছেন। সুতরাং যে কাজ রাসুল (সা.) করেননি, যে কাজ সাহাবায়ে কেরামও পরিহার করেছেন। ২৭ রজবে প্রচলিত ইবাদত বন্দেগিগুলোকে দ্বীনের অংশ মনে করা, সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা অথবা এসব প্রচলনের সঙ্গে সুন্নতের আচরণ করা বিদআত।
● সাহাবারা দ্বীন সম্পর্কে বেশি অবগত:
বাস্তবতা হলো, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন দ্বীনের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জানতেন। দ্বীনের ওপর পরিপূর্ণ আমল তাঁরাই করেছিলেন। অতএব এ রাতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা বিদআত। প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা যে ইবাদতের তৌফিক দেন তা তো অনেক উত্তম। সুতরাং ২৭ তারিখেও রাত জেগে ইবাদত করুন। ২৬ তারিখেও রাত জাগেন। তেমনিভাবে ২৭ তারিখের পরও রাত জাগুন। কিন্তু ২৭-এর রাতের সঙ্গে অন্য রাতের পার্থক্য প্রমাণিত নয়।
● ২৭ রজব কোনো রোজা নেই:
কেউ কেউ আশুরা ও আরাফার রোজার মতো ২৭ রজবের রোজাকে ফজিলতপূর্ণ মনে করে। এ ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই। ওমর (রা.)-এর আমলে কিছু লোক ২৭ রজব রোজা রাখতে শুরু করল। ওমর (রা.) জানতে পারলেন, কিছু লোক ২৭ রজবকে গুরুত্ব দিয়ে রোজা রাখছে। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। প্রত্যেকের কাছে গিয়ে জোর করে বললেন, আমার সামনে খাবার খাও। প্রমাণ করো তুমি রোজাদার নও। অন্যান্য দিন যেমন নফল রোজা রাখা যায়, এদিনও রাখা যেতে পারে। এদিনের সঙ্গে অন্য দিনের কোনো পার্থক্য নেই। এমনটি তিনি করেছিলেন যেন বিদআতের দরজা রুদ্ধ হয়।
● আনুগত্যের নাম দ্বীন:
ওমর (রা.) মন্দ দিকটি বলে দিয়েছেন। তা হলো এদিনে রোজা রাখতে আল্লাহ বলেননি। ধর্মের মধ্যে মনগড়া কিছু পালন করাই আসল খারাপ দিক। দ্বীনের মূল সারাংশই হলো অনুসরণ ও আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করা। কোথায়ও কিছু নেই, ইবাদতেও কিছু নেই। নামাজেও কিছু নেই। যখন নামাজের আদেশ হয় তখন নামাজ পড়া ইবাদত। যখন নামাজ না পড়ার আদেশ হয়, তখন নামাজ না পড়া ইবাদত। এ সময় রোজার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসবে তখন রোজা না রাখাই ইবাদত। এ সময় রোজা রাখলে দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ হবে। দ্বীনের সব কিছু আল্লাহর অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই দিনকে বেশি ফজিলতপূর্ণ মনে করে, সুন্নত মনে করে, মুস্তাহাব ও অধিক সওয়াবের উপায় মনে করে রোজা রাখা এবং রাত জাগা ঠিক নয়; বরং বিদআত।
● শিরনি করা:
শবেমিরাজের তো ভিত্তি আছে যে এ রাতে রাসুল (সা.) ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন। কিন্তু আজকাল ফরজ-ওয়াজিবের মতো যে জিনিসটি ছড়িয়ে পড়েছে, তাহলো শিরনির আয়োজন। শিরনি না করলে যেন মুসলমানই নয়। নামাজ পড়ুক না পড়ুক, রোজা রাখুক বা না রাখুক, গুনাহ পরিত্যাগ করুক বা না করুক শিরনি কিন্তু করতেই হবে। কেউ যদি শিরনি না করে অথবা শিরনি করতে বাধা দেয় তাকে সব ধরনের নিন্দা করা হয়। আল্লাহই জানেন, এ শিরনি প্রথা কোত্থেকে এলো। না কোরআনে আছে, না হাদিসে আছে। না সাহাবায়ে কেরাম করেছেন, না তাবেঈন, না তাবে তাবেঈন করেছেন, না বুজুর্গানে দ্বীন করেছেন। এর কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
● কুসংস্কারে হারিয়ে গেল উম্মত:
এসব জিনিস উম্মতকে কুসংস্কারে লিপ্ত করেছে। এ ধরনের বিষয়কে আবশ্যক মনে করা হচ্ছে। বাস্তব ও সঠিক জিনিসগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুসলমান ভাইদের বিষয়টি বোঝাতে হবে। এ জন্য যে, অনেক মানুষই না বুঝে করছে, মনে কোনো একগুঁয়েমি নেই। তারা দ্বীন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয়। এ বিষয়টি তারা জানে না। এসব মানুষের বিনয় ও ভদ্রতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে বোঝানো উচিত। এ ধরনের কাজ থেকে নিজেরও বেঁচে থাকতে হবে।
মুফতি শরিফুল আজম
লেখক : মুহাদ্দিস, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ
Post a Comment