আল্লাহ কি শয়তানের সাথে অবিচার করেননি?

বহু নাস্তিক আর সংশয়বাদীরা মনে করেন শয়তানের সাথে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালার বিচারটা ঠিক ন্যায় সংগত হয়নি। ঠোঁট উল্টে তাদের অনেকেই প্রশ্ন তোলেন— “কেবল মাত্র একটি ভুলের জন্য এত্ত বড় শাস্তি? ইবলিসের এত বছরের আমলগুলোর কোন মূল্য নেই? চির জাহান্নাম কেবল একটি ঘটনার জন্যই?” Devil worshipper দের শয়তান পুজার মূলেও এই প্রশ্ন বা সংশয়টি ই প্রধান।

ব্যাপারটার একটু সুরতহাল করা যাক। কোনো কিছুকে পরিমাপ বা বিচার করতে হলে প্রথমেই তার পরিমাপের একক বা নিক্তিটা যথাযথ হওয়া উচিত। যেমন— পঞ্চম শ্রেণীর একজন ছাত্রের সাথে গ্র্যাজুয়েট কোনো ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা বা সামাজিক অবস্থান তুলনা করাটা যেমন নেহায়াত বোকামি, তেমনি শয়তানের করা ‘কেবল একটিমাত্র ভুলের’ সাথে বাকি সৃষ্টির সব কিছুর ‘কেবল একটিমাত্র’ ভুল করাটা গুলিয়ে ফেলাও বোকামি।

আমাদের মাথায় রাখা উচিত ইবলিস এবং আমাদের ভুল বা পরীক্ষা কখনোই এক নয়। ইবলিস ছিল মহাজ্ঞানী এক সত্ত্বা। যে নিজের আমল দ্বারা এতটাই মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল যে তাকে সম্মানিত ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আপনার-আমার আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা, তাঁর পথে সর্বদা অবিচল থাকাটা অনেকটাই কষ্টকর; কারণ আমরা কেউ আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করিনি, তার সাথে কথা বলিনি, ফেরেশতাদের দেখিনি, মহাবিশ্বের রহস্যের প্রায় কিছুই আমরা জানি না। কিন্তু শয়তানের সাথে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন, সে ফেরেশতাদের সাথে থাকতো, এমনকি আল্লাহ তায়ালার মহাপরিকল্পনার অনেক কিছুই তাকে জানানো হয়েছিল। তার জ্ঞানের সীমা আমাদের আম জনতার চাইতে অনেক অ-নে-ক গুণে বেশি। আল্লাহর অবস্থান কতটা উপরে আর সমগ্র সৃষ্টি এর সামনে কতটা অসহায়, কতটা মুখাপেক্ষী, আর আল্লাহ তায়ালা যে সকল প্রশ্ন এবং জ্ঞানের উর্ধ্বে তা ইবলিসের চাইতে ভালো আর কে জানতো? দৃঢ়ভাবে সবকিছু জেনে-বুঝে প্রায় স্বেচ্ছায় সে তার নিজ পরিনতি বেছে নিয়েছে। ঘটনাটা সুরা সা’দ এ এসেছে এভাবে —

“৭৩> অতঃপর সমস্ত ফেরেশতাই একযোগে সিজদায় নত হলো,
৭৪> কিন্তু ইবলিস; সে অহংকার করলো এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
৭৫> আল্লাহ বললেন, হে ইবলিস, আমি নিজ হাতে যাকে সৃষ্টি করেছি, তার সম্মুখে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিলো? তুমি অহংকার করলে, না তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন?
৭৬> সে বললঃ আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা।
৭৭> আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা, এখান থেকে। কারণ, তুই অভিশপ্ত।
৭৮> তোর প্রতি আমার এ অভিশাপ বিচার দিবস পর্যন্ত স্থায়ী হবে।
৭৯> সে বললো: হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।
৮০> আল্লাহ বললেন তোকে অবকাশ দেওয়া হল।
৮১> সে সময়ের দিন পর্যন্ত যা জানা।
৮২> সে বললো, আপনার ইযযাতের কসম নিশ্চই আমি সবাইকে বিপথগামী করে দেব।“[1]

আল্লাহর সাথে ইবলিসের এই কথোপকথনে ইবলিসের চরিত্রের দিকগুলো বেশ ভালোভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। ইবলিস নিঃসন্দেহে আল্লাহর গায়েবের জ্ঞান সম্পর্কে জানতো। আল্লাহ তা’য়ালা যে আগের-পরের সবকিছুই জানেন তাও সে জানতো, এবং এও জানতো আল্লাহ যেহেতু আদমকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন সেহেতু সেটা অবশ্যই সত্য এবং এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবুও সে ঘাড় বেঁকিয়ে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো— “আমি আগুন, সে মাটি। আমি ই সেরা” ! [ভাবার্থ]

ঘটনার এখানেই ইতি টানলে কিছুটা ছাড় দিয়ে তাকে একটা সিম্প্যাথির জায়গা দেওয়া যেত; কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আল্লাহ তা’য়ালা যখন রুষ্ট হয়ে তাকে বের করে দিতে চাইলে সে আল্লাহর কাছে দুয়া করলো। দুয়ায় সে মাফ বা ক্ষমা চায়নি। সে বলতে পারতো আমি এত বছর আপনার ইবাদাত করেছি; আপনার একান্ত অনুগত ছিলাম, আমায় মাফ করুন, আমার ভুল হয়েছে। এসবের ধার ইবলিস ধারলো না। সোজাসুজি আল্লাহর কাছে সে সময় চাইলো, উদ্দেশ্য— আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা যেই সৃষ্টিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তাদের বিপথগামী করে ধ্বংস করে ফেলা।

ব্যাপারটা অনেকটা এমন— ধরুন, আপনার অফিস বসের কোনো একটা সিদ্ধান্ত আপনার ঠিক মনঃপুত হলো না। আপনি তার সাথে তর্কে জড়ালেন, এবং তার সাথে ঘোরতর বেয়াদবি করলেন। তিনি রাগ করে আপনাকে বের হয়ে যেতে বলা মাত্রই; আপনি শার্টের কলার উঁচিয়ে বললেন- আপনার হাতে তৈরি এই ব্যবসা, এই অফিস আমি ধ্বংস করে দেব, সময় দেন খালি পারলে।

যখন সামান্য বসের সামনে এহেন ধৃষ্টতার দৃশ্য কল্পনা করতেই আমাদের রুচি বিরোধী মনে হয়, তখন এ মহাবিশ্বের একচ্ছত্র মালিক, জগতসমূহের স্রষ্টা, এমনকি অনস্তিত্ব থেকে অস্ত্বিত্বে নিয়ে আসা খোদ ইবলিস তার রবের সামনে দাঁড়িয়ে যে আচরণ করেছে সেটা ঠিক কোন হিসেবের পাল্লায় মাপা যায়?

আদম(আ.) আর শয়তানের মাঝে খুব বড় একটা পার্থক্য লক্ষণীয়। আদম (আ.) ও একটা ভুল করে ফেলেছিলেন। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তিনি নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেললেন; এরপর তিনি কিন্তু ভাব ধরে বলেননি আমি সৃষ্টির সেরা যা খুশি খাইবো, কার তাতে কী? তিনি সাথে সাথে আল্লাহর সামনে লুটিয়ে পড়লেন; ক্ষমা আর অনুগ্রহ কামনা করতে লাগলেন যতক্ষন না আল্লাহ তা’য়ালা খুশি হন।

ফলাফল? তিনি ক্ষমা পেয়ে নবী হয়ে গেলেন এবং কিয়ামাত পর্যন্ত মানুষের কাছে সম্মানিত হয়ে আর ইবলিস ভুল করেও তার উপর অটল থাকলো, ফিরে তো এলোই না, বরং একের পর এক চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিদায় নিল আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালার পথ থেকে। কিয়ামাত পর্যন্ত আয়ু পেয়েও সে কখনোই আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে না। এত লম্বা সময় আর সুযোগ সৃষ্টির আর কেউ কক্ষনো পায়নি, তবুও সে নাফরমানি করবেই।

আল্লাহ তায়ালা গায়েবের, সব কিছুই জানেন। এবং জানেন বলেই তিনি জানতেন শয়তান কখনোই ফিরে যাবে না বা তওবাও করবে না; এর ফলশ্রুতিতেই আল্লাহ তায়ালা শয়তানের জন্য চির জাহান্নাম প্রস্তুত করে তাকে অভিশপ্ত করে দিলেন। মজাটা জানেন? তাকে এই জাহান্নামের সু-সংবাদ দেবার পরও সে ঘাড় ত্যাড়া করেই বসে রইলো। এতটূকু অহংবোধ কমলো না।

ইবলিস ভুলে গিয়েছিল সে কার সামনে দাঁড়িয়ে যুক্তির খেলাটা খেলছে। কার সামনে ওজর দেখাচ্ছে।

মানুষের চিন্তার খোরাক জাগানোর মতো রয়েছে অনেক কিছু এ ঘটনায়। আমরা কি বলতে পারবো ভুল জেনেও জীবনে কত মানুষের সাথে কেবল তর্কে নিজেকে সেরা প্রমাণের চেষ্টা করেছি আমরা? বারবার ভুল করার পরও ক্ষমা না চেয়ে ঠিক কতবার অহংকার করে নিজের ভুল ঢাকার চেষ্টা করে গেছি? কতবার ওজর দেখিয়ে আল্লাহ এবং মানুষকে বুঝ দিতে চেয়েছি এসব আমল না করলেও চলবে আমার?

সবশেষে সুরা বাকারাহর ৩৪ নাম্বার আয়াতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার রয়েছে—
… সে কাফিরদের [অবিশ্বাসীদের, অস্বীকারকারীদের] একজন ছিল।

এ থেকে বোঝা যায় ইবলিসের আগেই আরো জিন ছিল। সে ই প্রথম জিন নয়। অর্থাৎ ইবলিসের আগেই আরও জিন ছিল, যাদের মধ্যে আগে থেকেই কাফির (অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞ) ছিল। হয় আদম (আ)-এর এই ঘটনার পরে ইবলিস সেই কাফির জিনদের দলের একজন হয়ে গিয়েছিল, অথবা সে আগে থেকেই মুখোশধারী কাফির জিনদের একজন ছিল।

আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইবলিসের মুখোশটা খুলে তার আসল রূপটা সবার সামনে বের করে দিয়েছিলেন।[2] তার ভেতরে যে প্রচণ্ড অহংবোধ, তা মহান আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাই কেবল একটামাত্র ভুলের জাস্টিফিকেশন দিয়ে ইবলিস নামক অকৃতজ্ঞ একটি সৃষ্টির প্রতি অন্তরের কোণে মমতা লালন করা ভুল নয়, মারাত্মক এবং ভয়াবহ বোকামির ই অপর নাম।


[1] সুরা সা-দ: [৭৩-৮২]
[2] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।



WRITER: ARMAAN IBN SOLAIMAN

Post a Comment

Previous Post Next Post