কেমন ছিলেন তিনি? – ৪ নবী(ﷺ) এর জীবনের বিভিন্ন দিক


প্রিয়জনদের সাথে মমতাময় আচরণ আমাদের স্বভাবজাত। প্রকৃত মহত্ত্ব তো তখন প্রকাশ পায় যখন রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরেও, কোন স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও আমরা কারো সাথে উত্তম আচরণ করি। তার খোঁজখবর নেই, বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়াই। ঠিক এ কারণেই আমরা অনেকেই হয়তো একজন ভালো স্বামী, ভালো স্ত্রী, অনুগত সন্তান কিন্তু উত্তম প্রতিবেশী নই।

রাসূল (সা) যেমন ছিলেন আদর্শ স্বামী, মমতাময় পিতা, তেমনি তিনি একজন উত্তম প্রতিবেশীও ছিলেন। পবিত্র কুর’আনের এ আয়াতকে যেন তিনি তাঁর অন্তরে ধারণ করেছিলেন-
“তোমরা ইবাদাত করো আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর ভালো ব্যবহার করো মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী। [সূরা নিসাঃ ৩৬]

তিনি প্রতিবেশিদের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাদের সম্মান করতেন, খোঁজখবর নিতেন। দুঃখ-কষ্টের সময় পাশে এসে দাঁড়াতেন। প্রতিবেশিরা বিরক্ত হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতেন। প্রতিবেশী ভালো কিংবা খারাপ হোক, তিনি তাদের সাথে সবসময়ই উত্তম আচরণ করেছেন। মদিনায় তাঁর প্রতিবেশী হিসেবে ছিলেন আনসার ও মুহাজির সাহাবীরা। আনসার সাহাবীদের মধ্যে ছিলেন সাদ ইবনে মুআয (রা), আবু আইয়্যুব (রা)। আর মুহাজিরদের সাহাবীদের মধ্যে ছিলেন আবু বকর (রা), আলী (রা), আব্বাস (রা)। তাদের সবার সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। সাহাবীরা রাসূল (সা) এর প্রতিবেশী হতে পেরে গর্ববোধ করতেন। বনু নাজ্জার গোত্র তো রীতিমত গর্বে ফেটে পড়তো। গর্বের সে অনুভূতি তাদের কবিতায় ফুটে উঠতো। রাসূল (সা) পাশ দিয়ে গেলে বালিকারা আবৃত্তি করতো-
“আমরা হচ্ছি বনু নাজ্জারের কন্যা,
মুহাম্মদের (সা) ন্যায় প্রতিবেশীর হয় না কোন তুলনা।”
রাসূল (সা) তাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, “আল্লাহ জানেন যে, আমি তোমাদের ভালোবাসি।”

আবার মক্কায় তিনি পেয়েছিলেন আবু লাহাব, আবুল আস ইবনে উমাইয়ার মতো বৈরী মনোভাবসম্পন্ন কিছু প্রতিবেশী। এরা তাঁর সাথে প্রচণ্ড বাজে আচরণ করতো, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতো। তবুও তিনি তাদের সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেননি। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। তিনি একবার সলাতরত অবস্থায় থাকাকালে এদের একজন তাঁর উপর ভেড়ার নাড়িভুঁড়ি ছুড়ে ফেলেছিলো। রাসূল (সা) দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, “ওহে আবদে মানাফের সন্তানেরা! প্রতিবেশীর সাথে এটা তোমাদের কেমন আচরণ?”

আনসার এক সাহাবী একদিন রাসূল (সা) কে এক ব্যক্তির সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। রাসূল (সা) তাঁর সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এটা দেখে আনসার সাহাবীর কষ্ট হতে লাগলো। লোকটি চলে যাবার পর সেই সাহাবী রাসূল (সা)- কে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! ঐ লোকটা আপনাকে এতোক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো যে আপনার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছিলো।” রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তাঁকে সত্যিই দেখেছো?” সাহাবী জবাব দিলেন, “হ্যাঁ।” রাসূল (সা) আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি জানো সে কে?” সাহাবী জবাব দিলেন, “জ্বী না।” রাসূল (সা) তখন বললেন, “উনি ছিলেন জিবরাঈল (আ)। তিনি আমাকে প্রতিবেশিদের সাথে উত্তম আচরণ করতে উপদেশ দিচ্ছিলেন। একসময় আমার মনে হলো, প্রতিবেশিদের হয়তো উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।”

জীবনের শেষ হজ্জে তিনি সবাইকে প্রতিবেশিদের সাথে সদাচারণ করতে বলেছেন। আবু উমামাহ (রা) বলেন, “নিজ উটে আরোহণরত অবস্থায় বিদায় হজ্জের সময় আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, ‘আমি তোমাদেরকে প্রতিবেশিদের সদাচারণ করতে উপদেশ দিচ্ছি’- তিনি এটা এতোবার বললেন যে, আমার মনে হলো, তিনি হয়তো প্রতিবেশিদেরকে আমাদের উত্তরাধিকার বানিয়ে দিবেন।”

প্রতিবেশিদের সাথে উত্তম আচরণ করা হচ্ছে ঈমানের নিদর্শন। রাসূল (সা) বলতেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন প্রতিবেশীদের সম্মান করে।” শুধু তাই না, যদি কারো খারাপ আচরণ থেকে প্রতিবেশিরা নিরাপদ না থাকে, তবে তিনি তার ঈমানকে বাতিল ঘোষণা করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর শপথ সে মুমিন না, আল্লাহর শপথ সে মুমিন না, আল্লাহর শপথ সে মুমিন না!” লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, “হে আল্লাহর রাসূল! কে সে?” রাসূল (সা) জবাবে বললেন, “যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশিরা নিরাপদ না।” এমনকি সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা বলে তিনি সাবধান করে বলেছেন, “যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”

পত্র-পত্রিকা খুললেই অসংখ্য খুনোখুনির সংবাদ নজরে আসে। এদের অধিকাংশই ঘটে প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্কের কারণে, তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্নস্যাৎ করার কারণে। অথচ এসবই কাবীরা গুনাহ। আল্লাহর রাসূল (সা) এসব থেকে আমাদের বারবার সাবধান করে গেছেন। তিনি একদিন সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যভিচার করার ব্যাপারে তোমরা কী বলো?” সাহাবীরা বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এটাকে হারাম করেছেন, তাই কিয়ামত পর্যন্ত এটা হারাম থাকবে।” রাসূল (সা) বললেন, “দশজন নারীর সাথে ব্যভিচার করার চেয়েও প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা বেশি পাপের কাজ।” তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “চুরি করা সম্পর্কে তোমরা কী বলো?” সাহাবীরা বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এটাকে হারাম করেছেন, তাই কিয়ামত পর্যন্ত এটা হারাম থাকবে।” রাসূল (সা) তখন বললেন, “দশটা বাড়িতে চুরি করার চেয়েও নিজের প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি করা বেশি গোনাহের কাজ।”

এক ব্যক্তি এসে রাসূল (সা) কে তার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অভিযোগ করলো। রাসূল (সা) তাকে ধৈর্য ধরতে পরামর্শ দিলেন। লোকটা বারবার এসে রাসূল (সা) কে একই অভিযোগ করল। রাসূল (সা) তখন তাকে বললেন, “(বাড়িতে ফিরে) যাও! তোমার সকল সম্পদ রাস্তায় ফেলে রাখো।” সে তাই করলো। মানুষজন সবকিছু নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে এমনটা করার কারণ জিজ্ঞেস করলো। লোকটা তখন সবকিছু খুলে ফেলল। শুনে সবাই সে প্রতিবেশীকে অভিশাপ দিতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে সে প্রতিবেশী রাসূল (সা) এর কাছে গেলো। মানুষজন তাকে অভিশাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করলো। রাসূল (সা) তাকে বললেন, “মানুষজন অভিশাপ দেয়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা তোমাকে অভিশাপ দিয়েছেন।” লোকটা অনুতপ্ত হয়ে বলল, “আমি আর এমনটা করব না।” রাসূল (সা) তারপর সেই অভিযোগদানকারী ব্যক্তিকে বললেন, "সবকিছু বাড়িতে নিয়ে যাও। তোমার প্রয়োজন মিটে গেছে।”

অনেকেই আছেন পাঁচ ওয়াক্ত সলাত পড়তে পড়তে কপালে দাগ বসিয়ে ফেলেন, অথচ রূঢ় আচরণের কারণে প্রতিবেশিরা তার সাথে কথা বলতেও ভয় পায়। এমন ব্যক্তিদের রাসূল (সা) জাহান্নামের সংবাদ দিয়েছেন। এক ব্যক্তি রাসূল (সা) কে বলল, “হে আল্লাহর রাসূল! এক মহিলা তার সলাত, সিয়াম আর দানশীলতার জন্য পরিচিত। কিন্তু সে তার প্রতিবেশিদের কথা দিয়ে কষ্ট দেয়।” রাসূল (সা) বললেন, “সে জাহান্নামে রয়েছে।” লোকটি আবার বলল, “একজন মহিলা নূন্যতম সলাত পড়ে, সিয়াম পালন করে, সামান্য কিছু শুষ্ক দুধ সদকা করে, কিন্তু সে তার কথা দিয়ে প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয় না।” রাসূল (সা) বললেন, “সে জান্নাতে রয়েছে।”

প্রতিবেশী হতে হলে যে তাকে কেবল মুসলিমই হতে হবে এমন কথা নেই। ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) বলেন, “প্রতিবেশী শব্দটি দ্বারা মুসলিম এবং অমুসলিম, পূন্যবান এবং পাপী, বন্ধু কিংবা শত্রু, উপকারী কিংবা অপকারী, আত্নীয় অথবা অনাত্নীয়, কাছের কিংবা দূরের সবাইকেই বোঝানো হয়।” এ কারণেই সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) যখন নিজ বাড়িতে এসে ভেড়া জবাই করতে দেখেছিলেন, তিনি তার ইহুদি প্রতিবেশিদের কিছু ভেড়ার মাংস দেয়া হয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

রাসূল (সা) প্রতিবেশিদের উপহার দিতে বলতেন। তিনি নিজেও প্রতিবেশিদের উপহার দিতেন। তাদের উপহার গ্রহণ করতেন। রাসূল (সা) বলতেন, “হে মুসলিম নারীরা! প্রতিবেশিদের (উপহার দেয়াকে) অবজ্ঞা করো না এমনকি যদি তা ভেড়ার ক্ষুরও হয়।” কেউ মাংসের ঝোল রান্না করলে তিনি তাতে পানি বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবেশিদের দিতে বলতেন। আমরা অনেকেই প্রতিবেশিদের খোঁজখবর একেবারেই নেই না। সে সুস্থ আছে নাকি অসুস্থ আছে, খেয়েছে কি খায়নি তা নিয়ে আমাদের অনেকেরই মাথাব্যাথা থাকে না। এদের সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন, “প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত জেনেও যে পেটভরে খেয়ে ঘুমোতে যায়, সে আমার প্রতি বিশ্বাস রাখে না।”

আমরা ভালো কাজ করছি না খারাপ কাজ করছি সেটা জানার মাপকাঠি রাসূল (সা) আমাদের দিয়ে গেছেন। এক ব্যক্তি রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলো, “কীভাবে বুঝবো যে আমি ভালো কাজ করছি না খারাপ কাজ করছি?” রাসূল (সা) তাকে বললেন,
“যদি তুমি তোমার প্রতিবেশিদের বলতে শোন যে তুমি ভালো কাজ করছো, তাহলে তুমি ভালো কাজ করছো। আর যদি তাদের বলতে শোন যে তুমি খারাপ কাজ করেছো, তাহলে তুমি খারাপ কাজ করেছো।”
------------------------------------
-----------
শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ এর “كَيـف عَــاملهُم صلى الله عليه وسلم” (Interactions Of The Greatest Leader) গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা-
.
‘কেমন ছিলেন তিনি?’
পর্ব ৪- প্রতিবেশিদের সাথে আচরণ
.
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ Click Here  এবং Click Here

ফেসবুক পেজঃ Click Here

Post a Comment

Previous Post Next Post