কেমন ছিলেন তিনি? -- ২


যখন ছোট ছিলাম, রাস্তায় পথ চলতে চলতে প্রায়ই দেখতাম মুরুব্বী গোছের একজন চোখ-মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী বেয়াদবি করেছি সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর মনে পড়তো, “এই যা! সালাম দিতে ভুলে গিয়েছি।” কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সালাম দেয়ার পর অপর পাশের ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝতে পারতাম সালামের উত্তর হয়তো নেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে ঠোঁটও নড়ত না, সালামের উত্তর নাকি মনে মনে নিয়েছেন। ছোটদের সালামের উত্তর সশব্দে নিলে সম্ভবত সম্মান কমে যায়।
.
তবে আমি যদি ১৪০০ বছর আগে মদিনার পথ ধরে হেঁটে যেতাম, তাহলে একজন মানুষ আমি সালাম দেয়ার আগেই আমাকে সালাম দিয়ে দিতেন।
হ্যাঁ! মুহাম্মদ (সা) এর কথাই বলছি।
তিনি এতোটাই নিরহঙ্কারী ছিলেন যে, চলার পথে শিশুদের দেখলে তাদের সালাম দিতেন। ছোট্ট মেয়েরা প্রশ্ন করার জন্য হাত ধরে তাঁকে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যেতে পারত।

তাঁর সন্তান ছিল মোট সাতজন। ছেলে তিনজন, মেয়ে চারজন। ফাতেমা (রা) ব্যতীত সবাই তাঁর জীবদ্দশাতেই মারা গিয়েছিলেন। কখনো তিনি নিজের সন্তান আর অন্য মুসলিম সন্তানের মধ্যে পার্থক্য করতেন না। ভালোবাসা লুকিয়ে না রেখে প্রকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। আরবরা যখন দেখত তিনি শিশু আর সন্তানদের এতো গুরুত্ব দিচ্ছেন, তারা অবাক হয়ে যেতো। এমন করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উনি বলতেন, “যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, (কিয়ামতের দিন) তাদের প্রতি দয়া করা হবে না।”
.
যে সময়টাতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত প্রোথিত করা হতো, সে সময়টাতে তিনি তাঁর কন্যাদের শুধু ভালোই বাসতেন না, সম্মানও করতেন। অনেকেই বেশি কন্যা সন্তান থাকাকে বোঝা মনে করেন। উনি কখনোই তাঁর মেয়েদেরকে বোঝা মনে করেননি। সবাইকে মমতার সাথে কন্যা শিশুদের লালন-পালন করতে বলতেন। কন্যা শিশুদের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে রাসূল (সা) বলেন, “যাদের কন্যা সন্তান দিয়ে পরিক্ষা করা হবে, আর তারা তাদের প্রতি সদয় থাকবে, (আখিরাতে) সেই কন্যারা তাদের আর জাহান্নামের মধ্যে পর্দা হয়ে দাঁড়াবে।”
.
তাঁর কন্যাদেরকে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। কোন কন্যাকেই তিনি জোর করে বিয়ে দেননি। বিয়ের পূর্বে অবশ্যই কন্যার মতামত জানতে চাইতেন। সবাইকে সাবধান করে বলতেন, “একজন কুমারী মেয়ের অনুমতি ছাড়া তাকে বিয়ে দেয়া যাবে না।” একবার জানতে পারলেন, এক মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে। উনি সাথে সাথে সে বিয়ে বাতিল ঘোষণা করেন।
.
মোহর নির্ধারণের বেলায় কঠোরতা আরোপ করতেন না। ফাতেমা (রা) এর বিয়েতে মোহর বলতে ছিল কেবল একটি বর্ম। বর্তমান সময়ে অনেকেই বিয়েতে উচ্চ মোহর থাকাটাকে একটা প্রথা বানিয়ে ফেলেছেন। তাদের কাছে মোহর হচ্ছে সম্মানের মাপকাঠি। অথচ এ মাপকাঠি আল্লাহর রাসূল (সা) দিয়ে যাননি। যদি মোহর সত্যিই সম্মানের মাপকাঠি হতো, তবে তাঁর কলিজার টুকরা ফাতিমার চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কে ছিল?
.
যখনই ফাতিমা (রা) তাঁকে দেখতে আসতেন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। তাকে চুমু দিতেন, আর নিজের জায়গায় তাকে বসাতেন। আবার বাবা যখন তাকে দেখতে আসতেন, ফাতিমা (রা)-ও একইভাবে পিতাকে অভ্যর্থনা জানাতেন। মেয়েকে সবসময় সাধারণ জীবনযাপনে শিক্ষা দিতেন। ফাতিমা (রা) নিজ হাতেই সংসারের সব কাজ করতেন। জাঁতা ঘোরাতে ঘোরাতে তার হাত অবশ হয়ে যেত। একবার তিনি পিতার কাছে নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে একজন দাসীকে চাইলে আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “আমি কি তোমাকে এমন কিছুর কথা বলব না যা তোমার জন্য দাসীর চেয়েও উত্তম? ঘুমোতে যাবার আগে তুমি ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ আর ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে।”
.
আল্লাহর রাসূলের (সা) সন্তান বলে তারা যাতে আত্নতুষ্টিতে না ভোগেন, সে কথাও তিনি বারবার তাদের মনে করিয়ে দিতেন। সাবধান করে বলতেন, “ওহে ফাতিমা! নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। আল্লাহর সামনে আমি তোমাকে একটুও রক্ষা করতে পারব না।”
.
রাসূল (সা) ছিলেন একজন ধৈর্যশীল পিতা। সন্তানদেরকেও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতেন। পৃথিবীতে থাকা অবস্থাতেই তাকে সহ্য করতে হয়েছে একে একে ছয় ছয়টি সন্তান হারানোর কষ্ট। ফাতিমা (রা)- ও যে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পর মারা যাবেন, তাও তিনি জানতেন। মেয়ে উম্মে কুলসুল (রা) মারা যাওয়ার পর যখন তাকে গোসল দেয়া হয়েছিল, তখন নিজের পরনের ইজার খুলে দিয়েছিলেন। পিতার পবিত্র পোশাক মেয়ের দেহকে আবৃত করেছিল। উম্মে কুলসুমের (রা) মৃত্যুর পরে তিনি তার কবরের পাশে বসে থাকতেন। নীরবে চোখের জল ফেলতেন। একমাত্র জীবিত পুত্র ইব্রাহীম (রা) যখন মারা গিয়েছিলেন, তখনো তিনি অশ্রু সংবার করতে পারেননি। কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, “চোখ অশ্রুসিক্ত। হৃদয় ব্যথিত। তবুও আমরা এমন কিছু বলি না যা আমাদের রবকে অসন্তুষ্ট করে। ইব্রাহীম! (বাবা আমার!) আমরা তোমার মৃত্যুতে ব্যথিত।”
.
সাতজন নাতি-নাতনী ছিল তাঁর। সবাইকেই প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। কখনো তাদের ধমক দেননি। একবার হাসান (রা) তাঁর কোলে থাকা অবস্থায় প্রসাব করে দিয়েছিলেন। আবু লায়লা (রা) এ দৃশ্য দেখে হাসান (রা)- কে রাসূল (সা) এর কোল থেকে নিতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার সন্তানকে ছেড়ে দাও। প্রসাব শেষ না করা পর্যন্ত তাকে ভয় পাইয়ে দিও না।”
.
হাসান (রা) আর হুসাইন (রা) এর জন্য তিনি দু’আ করতেন। তাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, “আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই সকল শয়তান আর সৃষ্টি থেকে, সকল হিংসুটে চোখ থেকে।” একদিন ফাতিমা (রা) এর ঘরে যেয়ে আদর করে ডাক দিলেন, “ছোট্ট সোনামণিটা কি এখানে আছে?” হাসান(রা) বের হয়ে এলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন। কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি। আপনিও তাকে ভালোবাসুন। আর যে তাকে ভালোবাসে, তাকেও আপনি ভালোবাসুন।”
.
আরেকদিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দেয়ার সময় লক্ষ্য করলেন হাসান (রা) আর হুসাইন (রা) বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন। রাসূল (সা) খুতবা থামিয়ে মিম্বর থেকে নেমে দ্রুত তাদের কোলে তুলে নিলেন। সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, “এ দুইজনকে (এ অবস্থায়) দেখে আমি ধৈর্য ধারণ করতে পারিনি।”
.
মেয়ে যয়নাবের (রা) কন্যা উমামাহ (রা)- কে কাঁধে নিয়ে তিনি জামাতে নামায পড়িয়েছেন। রুকু আর সিজদা করার সময় তাকে নামিয়ে দিতেন, রুকু-সিজদা শেষ হলে আবার তাকে কোলে তুলে নিতেন। নামাযে রুকু করার সময় একবার হাসান কিংবা হুসাইন (রা) তার কাঁধে উঠে বসলেন। তিনি না থামা পর্যন্ত রাসূল (সা) রুকুতে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন। সবাই ভয় পেয়ে ভেবে বসল, রাসূল (সা) অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন কিনা! নামায শেষে লোকদের আশ্বস্ত করে বললেন, “তেমন কিছুই হয়নি। আমার ছেলে আমার কাঁধে চড়ে বসেছিল। সে সুস্থির না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে নামানো পছন্দ করলাম না।”
অথচ আমাদের সময়ে আমরা শিশুদের মসজিদে অনাহূত মনে করি। তাদের সামান্য শব্দে কিংবা দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে যাই।
.
তিনি তার নাতিদের প্রায়ই জড়িয়ে ধরতেন। চুমু খেতেন। এক ব্যক্তি তাঁকে এভাবে চুমু দিতে দেখে একবার বলল, “আমার দশটা ছেলে-মেয়ে আছে। আমি কখনোই তাদের চুমু খাইনি।” রাসূল (সা) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাদের অন্তরে দয়া নেই, তাদেরকে দয়া করা হবে না।” হাসান-হুসাইনের লালা গড়িয়ে তাঁর পবিত্র দেহে পড়ত। তিনি একটুও বিরক্ত হতেন না।
.
ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলে তিনি নাতি-নাতনীদের সাথে দেখা করতেন। তাদের পিঠে উঠিয়ে নিয়ে খেলা করতেন। একদিন দাওয়াত খেতে যাবার সময় দেখলেন হাসান (রা) কিংবা হুসাইন (রা) রাস্তায় খেলছেন। নানাকে দেখে নাতি কখনো ডানে কখনো বা বামে দৌড়ে পালাচ্ছিল। নাতির সাথে সাথে নানাও দৌড়াচ্ছিলেন।
.
কখনো কখনো নাতি-নাতনীদের উপহারও দিতেন। একবার নাজ্জাশীর বাদশাহ রাসূল (সা)-কে উপহার হিসেবে স্বর্ণের গয়না উপহার পাঠালেন। তিনি সে গয়না উমামাহ (রা)-কে উপহার দিলেন।
.
যখন সংশোধন করা প্রয়োজন তখন আদ্রভাবেই তা করতেন। একদিন দেখলেন হাসান (রা) সদকা থেকে নেয়া খেজুর মুখে দিয়েছেন। উনি সাথে সাথে বললেন, “ফেলে দাও, ফেলে দাও। তুমি কি জান না আমরা সদকার খাবার খাই না?”
.
বলা হয়ে থাকে, “একজন ব্যক্তি কতোটুকু মহৎ তা বোঝা যায়, শিশুদের প্রতি তার আচরণ দেখে। কেউ কি এমন আছে কিংবা কখনো ছিল, শিশুদের প্রতি যার আচরণে রাসূল (সা) এর চেয়েও বেশি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে?
------------------------------------
-----------
শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ এর “كَيـف عَــاملهُم صلى الله عليه وسلم” (Interactions Of The Greatest Leader) গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা-
.
‘কেমন ছিলেন তিনি?’
পর্ব ২- সন্তান ও শিশুদের সাথে আচরণ
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ Click Here  এবং Click Here

ফেসবুক পেজঃ Click Here

Post a Comment

Previous Post Next Post