কেমন ছিলেন তিনি? {নবী(ﷺ) এর জীবনের বিভিন্ন দিক}


একজন মানুষকে দূর থেকে দেখলে অসাধারণ মনে হয়। ভুলের উর্ধ্বে মনে হয়। দূরত্ব যত কমে, মানবীয় দূর্বলতা ততো প্রকাশ পায়। কখনো কখনো ভেতরের কদর্য রূপও প্রকাশ পায়, যেটা হয়তো দূর থেকে আমরা চিন্তাও করতে পারি না। এ কারণেই একজন মানুষের ভেতর ও বাহিরের আসল রূপ সবচেয়ে ভালোভাবে জানতে পারে তার জীবনসঙ্গিনী। সে কি ডা. জেকিল না মি. হাইড সেটাও তার স্ত্রীর চেয়ে ভালো কেউই বলতে পারবে না। রাসূল (সা) তাই বলতেন, “তোমাদের মধ্যে সেই তো সবচেয়ে উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট সবচেয়ে উত্তম।”
.
রাসূল (সা) যে তাঁর স্ত্রীদের নিকট সবচেয়ে উত্তম ছিলেন তা স্ত্রীদের সাথে তাঁর উষ্ণ ও মমতাপূর্ণ আচরণই বলে দেয়। প্রতিদিন সকালে তিনি ফজরের পর স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন। তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। আসরের পর তাদের সাথে আরেকবার দেখা করতেন। সে সময়ে কখনো তাদের জড়িয়ে ধরতেন, কখনো বা চুমু খেতেন।
.
স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন সর্বমোট এগারোজনকে। এর মধ্যে দু’জন তাঁর জীবদ্দশাতেই মারা গিয়েছিলেন। বাকি নয় জন স্ত্রীদের সাথে তিনি পালাক্রমে থাকতেন। এ ব্যাপারে কখনো অবিচার করতেন না। একজন স্ত্রী প্রতি নয় দিন পর তাঁর সাথে থাকার সুযোগ পেতেন। যদি নয় দিন পর পর তিনি স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন, তবে তা তাদের জন্য অনেক কষ্টকর হতো। শূন্যতাবোধ যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য তিনি প্রতিদিনই দু’বার করে তাদের সাথে দেখা করতেন। স্ত্রীরা তাই ভাবতেন, “রাসূল (সা) তো সবসময় আমাদের সাথেই আছেন।” এখনকার সময়ে আমরা স্ত্রীদের অনুভূতির দিকে একেবারেই মনোযোগ দেই না। সারাদিন কাজ নিয়ে পড়ে থাকি। রাতের বেলা বিছানায় শরীর এলিয়ে দেই। অথচ তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আমি চাইলে কিন্তু সহজেই পারি তাকে আমার অনুভূতির কথা অফিসে বসেই জানাতে। কাজের ফাঁকে তাকে ছোট্ট করে একটা মেসেজ দিয়ে রাখতে পারি। ভালোবাসার কথা জানাতে পারি।
.
যখন তিনি নতুন কাউকে বিয়ে করতেন, তখন সব স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন। তিনি জানতেন, স্ত্রী হিসেবে তাদের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। তাই দেখা করে যেন তাদের জানিয়ে দিতেন, “হয়তো নতুন একজনকে বিয়ে করেছি, কিন্তু তোমাদের কিন্তু একটুও ভুলে যাইনি। কখনো ভুলে যাবও না।”
.
সবার প্রথমে তিনি বিয়ে করেন খাদিজা (রা)-কে। তখন তিনি পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক। খাদিজা (রা) এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। খাদিজা (রা) এর সাথে একটানা পঁচিশ বছর ঘর করেছেন। এ সময়ে তিনি আর কাউকে বিয়ে করেননি। নিজের দাম্পত্য জীবনের দুই-তৃতীয়াংশই কেটেছে তাঁর খাদিজা (রা) এর সাথে। তাই আবেগের একটি বড় অংশ ছিল খাদিজা (রা)- কে ঘিরেই। সে ভালোবাসা মৃত্যুর পরেও শেষ হয়ে যায়নি। যখনই তাঁর সামনে খাদিজা (রা) এর কথা উল্লেখ করা হতো, তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে যেতো। তিনি অকপটে স্বীকার করতেন, “আল্লাহ্‌ তায়ালাই তাঁর (খাদিজার) প্রতি ভালোবাসা আমার অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন।”
.
সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন আয়েশা (রা)-কে। এমনকি আয়েশা (রা)-ও ঈর্ষাকাতর হয়ে যেতেন বারবার রাসূল (সা) এর মুখে খাদিজা (রা) এর প্রশংসা শুনে। একবার তো বলেই ফেললেন, “মনে হয় খাদিজা ছাড়া দুনিয়াতে কোন নারীই নেই।”
.
আরেকবার খাদিজা (রা) এর বোন হালাহ (রা) রাসূল (সা) এর সাথে দেখা করার অনুমতি চাইলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অনেকটা খাদিজা (রা) এর মতোই। সে কণ্ঠস্বর শুনে রাসূল (সা) এর খাদিজা (রা) এর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, “হালাহ হবে হয়তো।” আয়েশা (রা) ঈর্ষাকাতর হয়ে বললেন, “আপনি কুরাইশের সেই দাঁত পড়ে যাওয়া মহিলাকে এখনো স্মরণ করেন! সে তো অনেক আগেই মারা গিয়েছে। আর আল্লাহ্‌ তায়ালা আপনাকে তাঁর চেয়েও উত্তম কাউকে দান করেছেন।” রাসূল (সা) প্রচণ্ড রাগ করে জবাব দিলেন, “আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাকে তার চেয়ে উত্তম বদলা দেননি। যখন সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে, তখন সে আমাকে সত্যবাদী বলেছে। যখন সবাই আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন সে আমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। আর তার মাধ্যমেই আল্লাহ্‌ আমাকে সন্তান দান করেছেন।”
.
বদর যুদ্ধে রাসূল (সা) এর মেয়ে যয়নাবের (রা) স্বামী বন্দী হয়েছিলেন। যয়নাব তখন স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে গলার হার পাঠিয়েছিলেন। সে হার যয়নাব (রা) এর বিয়ের সময় খাদিজা (রা) নিজ গলা থেকে খুলে দিয়েছিলেন। রাসূল (সা) এ হার দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তাঁর চোখ পানিতে ভিজে গেলো। তিনি সাহাবীদের বললেন, “তোমরা যদি রাজি থাকো, তাহলে এ হার ফিরিয়ে দাও এবং বন্দীকে পণ ব্যতীতই বন্দীকে মুক্ত করে দাও।” যখনই কোন ছাগল জবাই করতেন, তখন খাদিজা (রা) এর স্মরণে কিছু মাংস তাঁর বান্ধবীদের উপহারস্বরূপ পাঠাতেন। যদি বান্ধবী না পেতেন, তবে মদিনার পথে পথে খাদিজা (রা) এর বান্ধবীদের খুঁজে বেড়াতেন। এমনকি যদি জানতেন, কেউ খাদিজা (রা)-কে পছন্দ করতো, তাকেও তিনি উপহার পাঠাতেন।
.
রাসূল (সা) ছিলেন ভীষণ রোমান্টিক একজন স্বামী। স্ত্রীদেরকে ভালোবাসার কথা অকপটে জানাতেন। রাতের বেলা আয়েশা (রা) কে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। হালকা গল্প করতেন। দু’জন একসাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। হেরে গেলে পরেরবার আয়েশা (রা)-কে হারিয়ে তার প্রতিশোধ নিতেন। আয়েশা (রা) পাত্রের যে দিক থেকে পান করতেন উনিও সেখান থেকে পান করতেন। আয়েশা (রা) হাড্ডির যে স্থান থেকে কামড় দিয়ে খেতেন, উনি সেই স্থানেই কামড় দিয়ে খেতেন। একবার হাবশিরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলছিল। রাসূল (সা), আয়েশা (রা)- কে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর আয়েশা (রা) সে খেলা দেখতে থাকেন রাসূল (সা) এর কাঁধ ও কানের মধ্যে দিয়ে। আয়েশা (রা) যে খেলা দেখা খুব উপভোগ করছিলেন তা কিন্তু না। তিনি দেখতে চাইলেন রাসূল (সা) কতোক্ষণ তার জন্য এভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। একসময় আয়েশা (রা)-ই ধৈর্য হারিয়ে চলে গেলেন।
.
আরেকবার আয়েশা (রা) তাকে বিশাল এক গল্প বলা শুরু করলেন। উনি ধৈর্য ধরে পুরো গল্পটা শুনে গেলেন। শুধু তাই না গল্প নিয়ে সুন্দর মন্তব্যও করলেন। মৃত্যুর ঠিক আগে আয়েশা (রা) এর ব্যবহার করা মিসওয়াক তিনি ব্যবহার করেছিলেন। দুজনের লালা এক হয়ে গিয়েছিল। আর আয়েশা (রা) এর কোলে মাথা রেখেই তিনি আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করেন।
.
স্ত্রীদের আদর করে ছোট ছোট নামে ডাকতেন তিনি। কখনো ভালোবেসে আলাদা একটা নামই দিয়ে দিতেন। আয়েশা (রা)-কে আদর করে ডাকতেন ‘হুমাইয়ারা’ (লাল-সুন্দরী) নামে। আয়েশা (রা) কখনোই মা হতে পারেননি। তাই যখন তার বোন একটি ছেলে জন্ম দিয়েছিলেন, তখন রাসূল (সা) বললেন, “ছেলেটার নাম হবে ‘আব্দুল্লাহ’। আর আজ থেকে তুমি হচ্ছো ‘উম্মে আব্দুল্লাহ’ (আব্দুল্লাহর মা)।’ সবাই এরপর থেকে আয়েশা (রা)-কে ‘উম্মে আব্দুল্লাহ’ নামেই ডাকত। অনেকেই তাদের স্ত্রীকে আদর করে ‘ময়না-পাখি’, ‘জানু’- এসব নামে ডেকে থাকেন। তারা হয়তো জানেন না যে, নিজের অজান্তেই রাসূল (সা) এর একটি সুন্নাহ তারা অনুসরণ করছেন।
.
সাফিয়া (রা) ছিলেন খাটো গড়নের। তাই যখন তিনি বাহনে আরোহণ করতেন তখন রাসূল (সা) তাকে ঢেকে দিতেন। তারপর হাঁটু বিছিয়ে দিতেন। সাফিয়া (রা) সে হাঁটুতে পা দিয়ে বাহনে আরোহণ করতেন। প্রত্যেক স্ত্রীই তাঁর কাছে ছিলেন রাণীর মতো। একজন রাণী রাজার কাছ থেকে যতোটা মর্যাদা পায়, তাঁর স্ত্রীরা তার চেয়েও বেশি সম্মান পেতেন।
.
প্রিয়তমাদের অনুভূতির দিকেও রাসূল (সা) সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। নিজের জীবনে দুঃখ-কষ্টের কোন শেষ ছিল না, তারপরেও স্ত্রীদের কষ্ট তাঁর চোখ এড়িয়ে যেতো না। একবার আয়েশা (রা) কে বললেন, “আয়েশা! তুমি কখন আমার উপর সন্তুষ্ট হও, আর কখন রাগ করো, আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারি।” আয়েশা (রা) অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, “কীভাবে আপনি তা বোঝেন?” রাসূল (সা) বললেন, “যখন আমার উপরে সন্তুষ্ট থাকো, তখন তুমি বলো, ‘এমন নয় মুহাম্মদের রবের কসম।' আর যখন কোন কারণে রাগ করো, তখন বলো, ‘এমন হয় ইব্রাহীমের রবের কসম।’
.
একবার সব স্ত্রীদের নিয়ে রাসূল (সা) ভ্রমণে বের হলেন। হঠাৎ করেই সাফিয়া (রা) এর উটটি অসুস্থ হয়ে বসে পড়ল। সাফিয়া (রা) এ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। তখন রাসূল (সা) এসে তার চোখের জল নিজ হাত দিয়ে মুছে দিলেন।
.
বিদায় হজ্জের সময় তিনি লক্ষ্য করলেন আয়েশা (রা) কাঁদছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আয়েশা (রা) এর মাসিকের সময় শুরু হয়েছে। তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “সকল নারীদের জন্যই আল্লাহ্‌ এটা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। হজ্জ করতে যা করা প্রয়োজন তুমি তার সবই করো, শুধু তাওয়াফটা করো না।”
.
অনেক স্বামীই স্ত্রীদের মাসিক শুরু হলে তাদের অছ্যুৎ মনে করে দূরে দূরে থাকেন। রাসূল (সা) মোটেও এমন করতেন না। আয়েশা (রা) এর মাসিকের সময়েই তিনি তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন। সে অবস্থাতেই তিনি রাসূল (সা) এর চুল আঁচড়ে দিতেন। একরাতে তিনি মায়মুনা (রা) এর সাথে একই চাদরের নিচে শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ মায়মুনা (রা) এর মাসিক শুরু হলে, তিনি দ্রুত উঠে পড়েন যাতে রাসূল (সা) এর পবিত্র দেহে রক্ত না লাগে। রাসূল (সা) সব বুঝতে পেরে তাকে ডেকে কাছে নিয়ে আসেন, দুজন আবার একই চাদরের নিচে শুয়ে থাকেন। স্ত্রীরা অসুস্থ হলে তিনি নিজে তাদের রুকিয়া করে দিতেন।
.
জীবনসঙ্গিনীদের কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কষ্ট দিতেন না। নিজের কাজ নিজেই করতেন। নিজের জুতো নিজ হাতেই ঠিক করতেন, নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, নিজেই নিজের কাপড় ধুতেন। ছাগলের দুধ দোয়াতেন। স্ত্রীদেরকে ঘরের কাজে সাহায্য করতেন। নবাব সাহেবের মতো পা তুলে শুধু স্ত্রীকে অর্ডারের পর অর্ডার দিয়ে যেতেন না। ঘন ঘন মিসওয়াক করতেন। সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। শরীরে যাতে কোন দুর্গন্ধ না থাকে সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন।
.
কখনোই কোন নারীকে তিনি প্রহার করেননি। মানুষদেরকে স্ত্রীদের প্রতি সদয় হবার নির্দেশ দিতেন। বলতেন, “নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে পাজরের বাঁকা হাড় থেকে। যদি একেবারে সোজা করতে চাও, তাহলে কিন্তু ভেঙ্গে ফেলবে।” বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি পুরুষদেরকে নারীদের প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
.
মক্কার কুরাইশ নারীরা ছিল স্বামীর প্রতি অনুগত। অপরদিকে, মদিনার নারীরা ছিল কিছুটা বিপ্লবী মনোভাবের। হিজরতের পর কুরাইশ নারীরা আনসার নারীদের সাথে মেলা-মেশা করেন। ফলে তাদের মধ্যেও প্রবল আত্নসম্মানবোধের উদয় হয়। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) তার স্ত্রীদের সাথে কুরাইশ পুরুষদের মতো আচরণ করেননি, বরং একজন আনসার যেভাবে তার স্ত্রীদের সাথে আচরণ করতেন, তিনিও সেরকম আচরণ করতেন। সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়েছেন তিনি। একবার তিনি আয়েশা (রা) এর ঘরে থাকাকালে সাফিয়া (রা) রান্না করে খাবার পাঠালেন। আয়েশা (রা) ঈর্ষাকাতর হয়ে সে পাত্র ভেঙ্গে ফেললেন। অনেক পুরুষই এ ক্ষেত্রে ক্ষেপে যাবে। কিন্তু রাসূল (সা) রাগ করলেন না। নিজ হাতে ভাঙ্গা পাত্রের টুকরো কুড়াতে কুড়াতে ভৃত্যকে বললেন, “তোমাদের মায়ের (আয়েশার) ঈর্ষা এসে গেছে।”
.
আবার, রূপকথায় যেমন ‘অতঃপর রাজা-রাণী একত্রে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’- এমন দেখা যায়, তাঁর জীবন তেমনও ছিল না। তাঁর স্ত্রীরা কখনো কখনো রাগ করে তাঁর সাথে সারাদিন কথা বলতেন না। তিনি সহ্য করতেন। একবার তিনিই রাগ করে এক মাস তাঁর স্ত্রীদের সাথে দেখা করেননি। কারো কোন আচরণে কষ্ট পেলে কখনোই উগ্রপন্থা অবলম্বন করতেন না। যে স্ত্রীর প্রতি মনোক্ষুন্ন হতেন, তার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিতেন। হাসি-ঠাট্টা করা কমিয়ে দিতেন। একসময় সেই স্ত্রীই নিজের ভুল বুঝতে পারতেন। তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতেন।
.
স্ত্রীদের প্রতি আচরণে পক্ষপাতিত্ব করতেন না। একবার আয়েশা (রা) সওদা (রা) এর গালে খাবার মাখিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূল (সা) হাসতে হাসতে সওদা (রা)-কে বললেন, তিনি যাতে আয়েশা (রা) এর গালে খাবার মাখিয়ে দেন। দুই সতীনের গালে খাবার মাখামাখি হয়ে একাকার হলো। যয়নাব (রা) একবার আয়েশা (রা)- কে কড়া কথা শোনালে, আয়েশা (রা) তার যথাযথ জবাব দেন। রাসূল (সা) তখন আয়েশা (রা) এর পক্ষ নেন। আবার আয়েশা (রা) যখন সাফিয়া (রা) এর খাটো অবয়ব নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছিলেন, তখন তিনি ঠিকই সাফিয়া (রা) এর পক্ষ নিয়েছিলেন। আয়েশা (রা) কে সাবধান করে বলেছিলেন, “তুমি এমন কথা বলেছো, যেটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে গোটা সমুদ্রের পানি দূষিত হয়ে যেতো।”
.
একদিন ঘরে এসে দেখলেন সাফিয়া (রা) কাঁদছেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, হাফসা (রা), সাফিয়া (রা)-কে ‘ইহুদীর মেয়ে’ বলেছেন। তিনি সাফিয়া (রা) কে সান্তনা দিয়ে বললেন, “তুমি একজন নবীর (হারুনের) কন্যা, একজন নবী (মূসা) তোমার চাচা, আরেকজন নবী তোমার স্বামী। কীভাবে সে (হাফসা) তোমার থেকে উত্তম হয়?”
.
স্ত্রীদের হাতে কলমে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। রমজানের শেষ দশ দিনের রাতে সব স্ত্রীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। আল্লাহর ইবাদত করতে বলতেন। আয়েশা (রা) কে বলতেন, “একটি খেজুর দিয়ে হলেও আগুন থেকে বাঁচো।” আয়েশা (রা)- কে ছোট ছোট গুনাহের ব্যাপারে সাবধান করে দিতেন। আবার তাঁর স্ত্রীরা যাতে ইবাদতে উগ্রপন্থায় চলে না যায়, সেদিকেও খেয়াল করতেন।
.
সুযোগ পেলেই স্ত্রীদের সাথে হাসি-তামাশা করতেন। ছোটবেলা আয়েশা (রা) পুতুল নিয়ে খেলতেন। রাসূল (সা) তার একটি পুতুল দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কী?’ আয়েশা (রা) জবাব দিলেন, ‘ঘোড়া।’ রাসূল (সা) আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘোড়ার মধ্যে এ দুটি কী?’ আয়েশা (রা) বললেন, ‘এটা হচ্ছে ঘোড়ার ডানা।’ রাসূল (সা) কৌতুক করে বললেন, ‘ঘোড়ার আবার দুইটা ডানাও রয়েছে?’ আয়েশা (রা) কম যান কীসে? সেই বয়সেই তিনি জবাব দিলেন, ‘বারে! আপনি কি জানেন না যে, সুলাইমান (আ) এর ঘোড়ার দুইটা পাখা ছিল।’ আয়েশা (রা) এর জবাব শুনে রাসূল (সা) এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর দাঁতের মাড়ি প্রকাশ পেয়ে গেলো।
.
আরেকদিন ঘরে এসে দেখলেন আয়েশা (রা) মাথা ব্যাথায় অতিষ্ঠ হয়ে বলছেন, “হায়! মাথা ব্যাথা।” রাসূল (সা) মজা করে বললেন, “আয়েশা! বরং আমার মাথায় ব্যথা হয়েছে। তোমার কোন সমস্যা নেই। তুমি যদি আমার পূর্বে মারা যাও তবে আমি তোমার পাশে থাকব, তোমাকে গোসল দিব, তোমাকে কাফন পরাব এবং তোমার জানাযার সলাত আদায় করব।” আয়েশা (রা) বললেন, “(হু! আমি মারা যাই) আর সে রাতেই আপনি আমার ঘরে অন্য বিবিকে নিয়ে থাকেন।” জবাব শুনে রাসূল (সা) হেসে ফেললেন।
.
রাসূল (সা) এর জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই উমার (রা) এর মতো কঠোর স্বভাবের মানুষ পর্যন্ত বলেছিলেন, “একজন মানুষের উচিত তার স্ত্রীর সাথে শিশুর মতো খেলা করা। আর যখন প্রয়োজন তখন বাইরে আসল পুরুষের মতো আচরণ করা।”
.
.
রাসূল (সা) ছিলেন স্বামী হিসেবে পৃথিবীর সকল স্বামীর রোল-মডেল। তাঁর স্ত্রীরাই সে কথার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। আয়েশা (রা) তাই তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, “কেন আমার মতো একজন নারী, আপনার মতো একজন পুরুষকে নিয়ে আত্নসম্মানবোধ করবে না?” সাফিয়া (রা) নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন,
.
“আমি আল্লাহর রাসূলের চেয়ে উত্তম আচরণের কোন ব্যক্তিকে দেখিনি।”
---------------------
----------
শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ এর “كَيـف عَــاملهُم صلى الله عليه وسلم” (Interactions Of The Greatest Leader) গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা-
.
‘কেমন ছিলেন তিনি?’
পর্ব ১ঃ স্ত্রীদের সাথে আচরণ 
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট: Click Here  এবং Click Here

ফেসবুক পেজঃ Click Here

Post a Comment

Previous Post Next Post