ইয়ামুল ফুরকান বা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারীর দিন



কাবার গিলাফটা মুঠো করে আঁকড়ে ধরলেন আবু জাহেল। তীব্র কন্ঠের দুআ-- “হে কাবা ঘরের রব্ব! যদি মুহাম্মদের ধর্ম মিথ্যা হয়ে থাকে তবে তাদের ধ্বংস করে দাও অথবা আমরা যদি মিথ্যার উপর থাকি তবে আমাদের ধ্বংস করে দাও।"

যুদ্ধ শুরু হলো। ভয়ংকর এক যুদ্ধ। স্থান মক্কা থেকে ১২০ আর মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরের মধ্যবর্তী একটি স্থান, বদর। মুসলিমদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন সরাসরি মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর সাথে সৈন্য সংখ্যা ৩১৩। উট ৭০ এবং ঘোড়া মাত্র দুটি। অপরদিকে অমুসলিমদের সেনাপতি উতবা বিন রাবিআ। তাদের সৈন্য সংখ্যা এক হাজার। ঘোড়া ১০০, ৬০০ লোহার বর্ম আর অসংখ্য উট।

আল আরিসা নামের একটি পাহাড়ের নিচে মুসলিমরা ঘাঁটি গাঁড়লেন। পানির কূপগুলো এর কাছাকাছি হওয়ায় তার নিয়ন্ত্রণও পেয়ে গেলেন তারা। সেনা সমাবেশের জন্য মুহাম্মাদ (সা.) এমন একটি জায়গা বাছাই করলেন যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ হলে কোনো মুসলিম সেনার চোখে সূর্যের আলো পড়বে না।

১৭ রামাদান, দ্বিতীয় হিজরি। ৩১৩ জন সাহাবা রাত কাটাচ্ছেন ‘আল আরিসার’ পাদদেশে। কেউ কেউ তাবুতে, কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে। চারদিকে রাতের মরুভূমির হিম শীতল পরিবেশ। এই মুসলিমদের ব্যাপার- স্যাপারটা একটু অন্য রকম। সামনে ভয়াবহ যুদ্ধ। হেরে গে্লে আয়-রোজগার, দেশ, বংশ, অস্তিত্ব সবই শেষ। তবু তারা কেমন যেন নিশ্চিন্ত মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাত বেড়ে আসতেই চাদর টেনে ঘুমোতেও চলে গেলো সবাই।

শুধু জেগে রইলেন একজন। মুহাম্মাদ (সা.)। সারা রাত কখনও সিজদায়, কখনও দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন ব্যাকুল কন্ঠে। কখনও সালাতে দাঁড়াচ্ছেন। কখনও শুন্যে হাত তুলে ধরছেন। একটা সময় সর্বশক্তিমানের হাতে নিজেকে সপে দিয়ে কান্নার দমকে অস্থির কণ্ঠে দুয়া করতে লাগলে--

"হে আকাশ ও জমিনের মালিক, তুমি দেখেছো, এই জালিম সেনাবাহিনীর অত্যাচার । তাদের জুলুমের সাক্ষী তুমি। তারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে, আজ এসেছে আমাদেরকে সমূলে শেষ করে দিতে ।

হে দয়ালু সত্তা, আমাদের অপরাধ তো কেবল এইটুকুই যে, আমরা শুধু তোমার উপর ঈমান এনেছি ।

আজ যদি এই মরুভূমিতে এই দলটি হেরে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এই পৃথিবীতে তোমার নাম নেয়ার মত আর কেউ বাকী থাকবে না ।

এই মানুষগুলো শুধু তোমার উপর ভরসা করে এখানে আমার সাথে চলে এসেছে । এদেরকে তুমি নিরাশ করো না । আজ তোমার সাহায্য ছাড়া, তোমার দয়া ছাড়া এই যুদ্ধে আমরা টিকতে পারবো না। আমরা তোমার সাহায্যের দিকেই তাকিয়ে আছি।"

অস্থির, ব্যাকুল কন্ঠে চিৎকার করে চলেছেন আল্লাহর রাসুল(সা.)। তাঁর গায়ের চাদরটা খুলে পরে যাচ্ছে বারবার। তাঁর এই অবস্থা দেখে ছুটে আসলেন রাসুলের(সা) এর সবসময়কার সাথী আবু বাকর(রা.)। শান্তনা দিলেন-- “হে আল্লাহর রাসুল(সা.), আপনি শান্ত হোন । নিশ্চয়ই, আপনার রব আপনাকে ত্যাগ করবেন না।”

তাঁর রব তাকে ত্যাগ করলেন না। তাঁর রব দুয়া কবুল করলেন। আবু জাহেল এবং রাসুল(সা.) দুজনেরই দুয়া। ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন কে বন্দী করার মধ্যে দিয়ে বিজয় আসলো ৩১৩ জনের ছোট্ট মুসলিম দলটির।

১৭ ই রমাদানের দিনটিকে বলা হল ইয়ামুল ফুরকান বা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারীর দিন। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো রমাদান। অনেকগুলো ১৭ তারিখ। স্রেফ হাসি তামাশা আর ইফতার পার্টিতে ব্যস্ত মুসলিমরা সবাই আছে ঠিকঠাক। শুধু নেই দৃঢ়তাটুকু, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারার সাহসটুকু। নেই একটা কন্ঠ। একটা আওয়াজ!

অনেক দূরে হেবরন কিংবা ইদলিবে রক্ত বয়ে যায়। সস্তা রক্ত। লোকে বলে মুসলিমদের নাকি সেসব। আমরা দূরে বসে ছবি-ভিডিও দেখি। মাঝে মাঝে আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ব্যাকুল কন্ঠে দুয়াটুকু করার মত পবিত্র মানুষটাও হতে পারলাম না...আফসোস...

লিখেছেন: ভাই আরমান ইবনে সোলায়মান

1 Comments

  1. কুরআনে কোন দিবসকে ইয়ামুল ফুরকান বলা হয়েছে

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post