গান-বাজনা ও গান-বাজনার অনুষ্ঠানের ব্যপারে সতর্কবার্তা



বিসমিল্লাহ। আলহা’মদুলিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহ। আম্মা বাআ’দ।


“আল্লাহ যাকে সঠিক পথ দেখান, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারেনা। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে কেউ পথ দেখাতে পারে না। আর আল্লাহ শুধুমাত্র ফাসেক্ব (পাপীষ্ঠ লোক) ছাড়া অন্য কাউকে পথভ্রষ্ট করেন না।”


আল্লাহ তাআ’লা বলেন, 

“(হে নবী!) আপনি আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিন। (সুসংবাদ তাদের জন্যে), যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর তার মাঝে যেই কথা উত্তম, তার অনুসরণ করে। আল্লাহ তাদেরকেই সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই হচ্ছে সত্যিকারের বুদ্ধিমান।” সুরা আয-যুমারঃ ১৭-১৮।


নবী করীম সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দ্বীন হচ্ছে নসীহাহ। অর্থাৎ অন্যের কল্যাণ কামনা করাই হচ্ছে দ্বীন।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, কার জন্য কল্যাণ কামনা ইয়া রাসুলুল্লাহ? তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআ’লা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুল এবং মুসলমানদের নেতৃবর্গ ও সমস্ত মুসলমানদের জন্য।” সহীহ মুসলিম।


মুসলিমদের জন্যে নসীহত হিসেবে আমি আল্লাহর উপর ভরস করে আপনাদের সামনে কিছু কথা তুলে ধরছি। আমি আশা করছি, আপনারা আমার উপরে রাগ না করে, কিংবা বিরক্ত না হয়ে মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনবেন ও এইগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন। ওয়ামা তোওফিক্বি ইল্লা বিল্লাহ। 


আল্লামাহ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আল-আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “বর্তমান যুগের মুসলিম নারী ও পুরুষেরা গান-বাজনাতে এতোটাই নিমজ্জিত যে, কেউ যদি দাঁড়ায় এবং ইসলামী শরিয়তে গান-বাজনা হারাম করা হয়েছে, এই কথা বলে, তাহলে লোকেরা তাকে ‘কট্টরপন্থী’ বলে মনে করে।”

গান-বাজনার ব্যপারে কথা বললে অনেকেই প্রশ্ন করে, “গান বাজনা হারাম, এই কথা কুরআনের কোথায় বলা হয়েছে?”

আপনি যদি মনোযোগ দিয়ে কুরআনুল কারীম পড়েন এবং এর অর্থ জানার চেষ্টা করেন, তাহলে দেখবেন গান-বাজনার ব্যপারে কুরআনে স্পষ্ট আয়াত নাযিল রয়েছে। আল্লাহর অনুমতিক্রমে নীচে তা বিবৃত ও ব্যখ্যা করা হলো।


‘লাহুয়াল হাদীস’

আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্যে অন্ধভাবে ‘লাহুয়াল হাদীস’ (অবান্তর, বেহুদা কথাবার্তা) ক্রয় করে, এবং আল্লাহর পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” সুরা লুকমানঃ ৬। 

উল্লেখিত আয়াতে ‘লাহুয়াল হাদীস’ কথাটির কি?

প্রখ্যাত সাহাবী আ’ব্দুল্লাহ ইবনু মাসউ’দ রাদিআল্লাহু আ’নহু এই আয়াতের তাফসীরে বলেছেন, “আমি সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, ‘লাহুয়াল হাদীস’ কথার অর্থ হচ্ছে গান।”

এছাড়া আরো দুইজন প্রখ্যাত সাহাবী আ’বদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আ’বদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়া’ল্লাহু আ’নহুমা, তাঁরাও একই কথা বলেছেন। 

বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান আল-বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এই আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যা বান্দাকে কুরআন থেকে গাফেল করে দেয়।” তাফসীরে ইবনে কাসীরঃ ৩/৪৪১


‘ইবলীসের আওয়াজ’

আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “(হে ইবলীস!) তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের (লোকদের) মধ্য থেকে যাকে পারিস তাকে পদস্খলিত কর।” সুরা ইসরাঃ ৬৩।

এই আয়াতের তাফসীরে সাহাবী আ’ব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিআ’ল্লাহু আ’নহুমা বলেছেন, “যে সকল জিনিস মানুষকে পাপাচারের দিকে আহবান করে, সেটাই হচ্ছে ইবলীসের আওয়াজ।” 

বিখ্যাত তাবেয়ী বিদ্বান মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ইবলীসের আওয়াজ বলতে এখানে গান ও বাদ্য-যন্ত্রকে বুঝানো হয়েছে।”

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব জিনিস মানুষকে পাপাচারের দিকে মানুষকে আহবান করে, তার মধ্যে গান-বাজনা সবচাইতে সেরা। এজন্যেই গান-বাজনাকে ‘ইবলিসের আওয়াজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।” ইগাসাতুল লাহফানঃ ১/১৯৯


উপরে কুরআনের আয়াত, সাহাবী, তাবেয়ী ও বিদ্বান ব্যক্তিদের আলোচনা থেকে আমরা জানি পারিঃ

(১) গান-বাজনা মূলতঃ আল্লাহর পথ (ইসলাম) থেকে মানুষের অন্তরকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে শয়তানের একটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। 

(২) গান-বাজনা মানুষকে আল্লাহর ব্যপারে, কুরআনের ব্যপারে উদাসীন করে দেয়। 

(৩) যারা গান বাজনা শুনতে অভ্যস্ত তারা নামায ত্যাগ করা, বেপর্দা চলাফেরা করা, বাবা-মা কিংবা স্বামীর অবাধ্য হওয়া, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা, যিনা-ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকা, অহংকার করা, বদ মেজাজী বা উগ্র স্বভাব ইত্যাদি খারাপ কাজে বেশি লিপ্ত হতে দেখা যায়। আর কেনইবা হবে না? গান মানুষের অন্তরে মুনাফেকীর জন্ম দেয়। যার অন্তর থেকে কুরআন চলে গেছে আর মুনাফেকী প্রবেশ করেছে, সে নিজেকে মুখে ইমানদার দাবী করলেও, তার অংগ-প্রত্যংগে পাপাচারের সমাবেশ ঘটবে।

সাহাবী আ’ব্দুল্লাহ ইবনু মাসউ’দ রাদিআল্লাহু আ’নহু “পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে, ঠিক তেমনি গান মানুষের অন্তরে মুনাফেকী সৃষ্টি করে।” ইগাসাতুল লাহফানঃ ১/১৯৩, তাফসীরে কুরতুবীঃ ১৪/৫২।


যাই হোক, বর্তমানে গান-বাজনা মুসলিমদের মাঝেই এতোটাই বেড়ে গেছে যে, মুসলিমদের অনেক আচার-অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য বা আকর্ষণ যেনো গান। 

(১) প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীর মোবাইল, কম্পিউটার, এমপিত্রির মাঝে হারাম গান-বাজনা।

(২) পিকনিক, স্টাডি ট্যুরে যাওয়া-আসার সময় মাইকে জোরে গান বাজানো হচ্ছে, তার সাথে ছেলে-মেয়েরা একাকার হয়ে উদ্দাম ও বেহায়াপনার নৃত্য করছে। নাউযুবিল্লাহি মিং যালিক।

(৩) বিয়ে, বৌভাত, গায়ে হলুদে অমুসলিমদের গান-বাজনা ও নাচ।

(৪) স্কুল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের মাঝে গান বাজনার প্রতিযোগীতা চলছে। সাথে অশ্লীলতা ও বেপর্দা নারীদের বিনোদন।

(৫) এমনকি যারা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা, যারা আমাদেরকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাদের অনেকেই ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গান-বাজনাতে উৎসাহিত করছে, কখনো বাধ্য করছে। তাদের অনেকের মন-মানসিকতা হচ্ছে, বিনোদনের জন্যে যা ইচ্ছা তা করা যায়। আমরা আধুনিক যুগে বসবাস করি, সবকিছুতে ধর্ম মানা জরুরী কোন কিছু না। এইভাবে অনেক শিক্ষক শিক্ষিকারা কৌশলে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মনে আল্লাহর অবাধ্যতা ও নাফরমানি, নাস্তিকতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন, আমিন।


এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বেই এই ব্যপারে আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্য হতে একদল লোক এমন হবে, যারা ব্যভিচার, (পুরুষেদের) রেশমি বস্ত্র পরিধান, মদ পান এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার ইত্যাদি (হারাম কাজকে) হালাল বলে মনে করবে।” সহীহ বুখারী, পোশাক অধ্যায়।

কেয়ামতের পূর্বে মুসলমান হয়েও যখন লোকেরা অত্যাধিক গান-বাজনাতে লিপ্ত হবে, গান-বাজনার কনসার্ট আয়োজন করবে, গায়িকাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং লোকেরা লজ্জাহীন নারীদের নাচ-গান নিয়ে আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে থাকবে, তখন তাদের শাস্তিস্বরূপ কিছু লোককে আল্লাহ শূকর ও বানর বানিয়ে দেবেন (নাউযুবিল্লাহি মিং যালিক)। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম “আমার উম্মতের কিছু সংখ্যক লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। তাদের মাথার উপরে গান-বাজনা ও নারী-নৃত্য চলতে থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে মাটিতে ধসিয়ে দেবেন। আর তাদের কতককে বানর ও শূকরে পরিণত করে দেবেন।” সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২/৩২৪৭।


এবার আসি অন্য একটি প্রসংগে। অনেকে নামাযী লোকেরা নিজেরা গান-বাজনা শুনে না। কিন্তু প্রকাশ্যে গান-বাজনা করা হয় এমন অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে শরীক হন। এইভাবে তারা মূলত সেই পাপী লোকদেরকে মৌন সম্মতি দিচ্ছেন। কারণ, আপনার সামনে কোন খারাপ কাজ করা হচ্ছে, আপনি সেটাকে বাঁধা দিচ্ছেন না, বরং তাদের সাথে বসে থেকে, তাদের পাপের অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করে আপনি তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছেন। এটা ভুল এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ। 

আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “আর (তারাই হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর সত্যিকার বান্দা), যারা কোন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না, এবং অসার কার্য-কলাপের সম্মুখীন হলে নিজের মান-মর্যাদা রক্ষার জন্যে সেইগুলো পরিহার করে চলে।” সুরা আল-ফুরক্বানঃ ৭২। 

আয়াতের তাফসীরঃ 

রহমানের বান্দাদের গুণ এই যে, তারা সকল প্রকার মিথ্যা কথা বা মিথ্যা অনুষ্ঠান ও মজলিসে উপস্থিত হয় না। অসার কার্য-কলাপ এমন প্রত্যেক কথা ও কাজকে বলা হয়, যাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন উপকার নেই। অর্থাৎ এমন কাজে ও কথায় মুমিনরা অংশগ্রহণ করে না; বরং চুপচাপ নিজ সম্মান বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাফসীর আহসানুল বায়ান।

গান-বাজনার ব্যপারে আলেমদের ফতোয়াঃ

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহকে গান-বাজনার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কেবলমাত্র ফাসিক (পাপীষ্ঠ) লোকেরাই তা করতে পারে।” তাফসীরে কুরতুবীঃ ১৪/৫৫। 

ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি গান-বাজনাতে লিপ্ত, সে হল একজন আহম্মক (নির্বোধ লোক)। তিনি আরো বলেছেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাক-ঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক (পাপীষ্ঠ)। আদালতে এমন লোকের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। ইগাসাতুল লাহফানঃ ১/১৭৯, তাফসীরে কুরতুবীঃ ১৪/৫৫। 

শায়খ সালেহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “সামান্য একটু ঠান্ডা পানি কানের ভেতরে প্রবেশ করলে আমাদের কতইনা ব্যথা-বেদনা হয়! তাহলে চিন্তা করে দেখো, গান শোনার কারণে যদি কারো কানের ভেতরে ফুটন্ত গরম সীসা ঢেলে দেওয়া হয়, তখন কতইনা কষ্ট হবে!”


সর্বশেষ, আমি আমার মুসলিমদেরকে অনুরোধ করবো, একটু চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে। পরকালে চিরস্থায়ী সুখের জীবন পাওয়ার জন্যে আমাদের আসলে কি করা উচিত...আর আমরা কি করছি!

আল্লাহ তাআ’লা বলেন,

আ’উযুবিল্লাহিমিনাশ-শাইত্বানির রাযীম। 

(৩০) তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতি (ইসলামের) অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই হচ্ছে সরল-সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা।

(৩১) বিশুদ্ধ চিত্তে তাঁর অভিমুখী হয়ে তাঁকে ভয় করো, সালাত কায়েম করো এবং (সেই সমস্ত) মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়োনা। 

(৩২) যারা তাদের দ্বীনে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। (তাদের) প্রত্যেকেই নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।” 

সুরা রুম, আয়াত ৩০-৩২

আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেন, “এই (ক্বুরানুল কারীম) মানুষের জন্যে একটি মহা সংবাদনামা, যাতে করে মানুষ এর দ্বারা ভীত হয়। আর যাতে করে তারা জেনে নেয় যে, একক উপাস্য একমাত্র তিনিই (আল্লাহ); এবং যাতে বুদ্ধিমানরা এর (আয়াতগুলো) নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে।” সুরা ইব্রাহীমঃ আয়াত ৫২।

Post a Comment

Previous Post Next Post